শফিকুল ইসলাম খোকন

শনিবার, ১৮ মার্চ, ২০২৩

শিশু বয়সেই বৈঠা হাতে দক্ষ তারা

: শফিকুল ইসলাম খোকন: 

 ১৩ বছরের শিশু রাকিবুল। এ বয়সে আর দশজন শিশুর মতোই তারও স্কুলে যাওয়ার কথা। কিন্তু ১০ বছর থেকেই এই দুরন্ত শিশুকে দারিদ্র্যে কষাঘাতে পড়তে হয়। ১৪ বছরের সাব্বিরের একই অবস্থা। সাব্বির আর রাকিবুল এখ
ন দক্ষ মাঝি। 

শুধু সাব্বির, রাকিবুলই নয়, তাদের মতো একই অবস্থা বরগুনার উপকূলবর্তী এলাকার অনেক শিশুর। পারিবারিক অভাব-অনটন এসব শিশুর হাত থেকে বই নামিয়ে তুলে দিয়েছে বৈঠা ও মাছ শিকারের জাল। এরকম অবস্থা দেশের আরও অসংখ্য শিশুর। এমন শিশুদের সম্পর্কে হয় অনেক সভা-সমাবেশ। কিন্তু সাব্বির-রাকিবুলদের জীবনের কোনো পরিবর্তন আসে না।  দিনে দিনে সাব্বির-

রাকিবুলের মতো দক্ষ মাঝি হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের অনেক শিশু। তাদের কেউ অভাবের তাড়নায়, কেউ পরিবারের অবহেলা ও অসচেতনতায়, আবার কেউবা সামাজিক অবয়ের কারণে। জলবাযু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলের শিশুরাও এমন ঝুঁকির পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এমনিতেই উপকূলের মানুষ দারিদ্রতার কারণে এসব কাজে ঝুঁকছে, পাশাপাশি শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়ছে শিশু।  

বিশেষ করে করোনার সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এবং পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে, পরে বিদ্যালয় খুললেও আর ফেরেনি। জলবাযু পরিবর্তনের ফলে জীবিকা পরিবর্তন হয়েছে এবং মাইগ্রেশন বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝরে পড়ার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

সুন্দরবন সংলগ্ন বলেশ্বর নদে সারি সারি নৌকা। তবে এই নৌকাগুলো দেখলে যে কেউ বুঝবেন এগুলো মাছ ধরার নৌকা। এসব নৌকায় কিছু মানুষের ঘর-বাড়িও। পরিবারের কাছ থেকে বড়দের মতো শিশুরাও বিদায় নিয়ে বলেশ্বর নদে মাছ শিকারে আসে। এ নদীতেই থাকতে হয় দিনের পর দিন ঘর বাড়ির মতো। যে বয়সে মায়ের কোলে নিরাপদে থাকার কথা জীবিকার তাগিদে নদীতেই থাকতে হয় ঝুঁকি নিয়ে। ঝড়-জলোচ্ছাস, প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার মধ্যেও এসব শিশুরা নদীতে থাকে। ঘূর্ণিঝড় আসলে সৃষ্টিকর্তার ওপরই একমাত্র ভরসা। সব সময় নদীর উত্তাল মোহনায় বেশ ঝুঁকির মধ্যেই এসব শিশুরা বেড়ে ওঠে। অবহেলার মধ্যে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দুরন্ত শৈশব কাটছে ওদের।

সরেজমিন বলেশ্বর নদ সংলগ্ন চরদুয়ানী ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে ট্রলার ও নৌকা ঘাটে নোঙর করে আছে। অনেক নৌকা-ট্রলার ঘাটে নোঙরের চেষ্টা করছে। ঠিক এমন সময় দেখা মেলে সাব্বিরকে। কচি হাতে শক্ত বৈঠা নিয়ে দক্ষ মাঝি মতো ঘাটে নৌকা আনছে। ঘাটে মাছ বিক্রি করার জন্যই এসব ট্রলার নিয়ে ঘাটে ফিরেছেন।

কথা হয় ১৩ বছরের শিশু সাব্বিরেরর সঙ্গে, চাচা আবুলের সঙ্গে ১০ দিন আগে পিরোজপুরের জিয়ানগর এলাকা থেকে পাথরঘাটা সংলগ্ন বলেশ্বর নদে মাছ শিকার করতে আসে। ১০ দিন মাছ শিকার করে মাত্র ৪ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করে। মাদরাসায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে আর পড়তে পারেনি। সেই থেকেই মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত সাব্বির।

কিভাবে পারিশ্রমিক পায় জানতে চাইলে শিশু সাব্বির বলে, এখানে দৈনিক ভিত্তিতে কোনো পারিশ্রমিক নেই। শেয়ারে ব্যবসার মতো। লাভ-লোকসান সমানে সমান। ৬ দিনের জন্য ৫ হাজার টাকার বাজার সদয় নিয়ে নদীতে মাছ ধরার জন্য বাড়ি থেকে আসি দাদার সঙ্গে। ১০ দিন থাকার পর মাত্র ৪ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেছি। কাঙ্খিত মাছ না পাওয়ায় বাড়ি না গিয়ে চরদুয়ানী ঘাটে এসে আবার বাজার সদয় করে নদীতে মাছ ধরার জন্য থাকতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত লাভের মুখ দেখিনি।

শিশু সাব্বিরের সঙ্গে কথা বলার সময়ই হঠাৎ চোখে পড়ে শিশু রাকিবুলের সঙ্গে। দাদা সেকান্দার হাওলাদার মাছ বিক্রির জন্য গেছেন চরদুয়ানী বাজারে। এদিকে ছোট নৌকায় বসে নিজে রান্না করছেন রাবিকুল। এ বয়সে রান্না তো দূরে থাক নদীতে এমন ঝুঁকির কাজ করার কথা নয়। পেটের দায়ে করতে হচ্ছে রাকিবুলের মতো অসংখ্য শিশুদের। কথা হয় রাকিবুলের সঙ্গে, গল্প বলেন দাদ্রিতা নিয়ে। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ২ মাস লেখাপড়া করেছিল রাকিবুল। মহামারি করোনার ছোবল আর পরিবারের অভাব-অনটনে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি তার।

এদিকে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকার পরিবারে অভাব-অনটন, স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া নানা কারণে দিন দিন বাড়ছে শিশু শ্রমিক ও জেলের সংখ্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলের বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত এমন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। অন্যদের সঙ্গে পেশায় টিকে থাকতে এসব শিশুরা ১২ থেকে ১৪ বছরেই হয়ে উঠছে দক্ষ জেলে ও মাঝি।  

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর পাড়ে অনেক শিশু, কিশোর-কিশোরী মাছ শিকারে ব্যস্ত। কেউ কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে কোমড় পানিতে নেমে জাল টানছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আরডিএফ) তথ্যানুযায়ী, পাথরঘাটা উপজেলায় ২১০০ শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ে। তার মধ্যে মেয়ে ৭৯৫ ও ছেলে ১৩০৫। এসব ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষামুখি করতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পাথরঘাটায় ৭০টি শিশুর শিখন কেন্দ্রের কার্যক্রম চলছে।

শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আরডিএফ) যুগ্ম পরিচালক মো. এনামুল হক বলেন, করোনা কালে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এবং পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে, পরে বিদ্যালয় খুললেও আর ব্যাক করেনি। তালতলীতে একটা জরিপ আছে, সেখানে বাল্যবিবাহ ও গার্মেন্টস এ যাওয়ার প্রবণতা বেশি।  

তিনি আরও বলেন, জলবাযু পরিবর্তনের ফলে জীবিকা পরিবর্তন হয়েছে এবং মাইগ্রেশন বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝরে পড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন চিত্র পুরো জেলায়।

এ বিষয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘জাগো নারী’র  পরিচালক ডিউক ইবনে আমিন বলেন, শিশু শ্রমকে স্থানীয়ভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে, যে সকল শিশু আর্থিক কষ্টের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং একই সঙ্গে তাদের পরিবারকে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।  

বেসরকারি সংস্থাগুলো স্কুল থেকে ঝরে পরা শিশুদের চিহ্নিত করে তাদের বিশেষ শিক্ষার মাধ্যমে আবার স্কুলমুখী করতে কাজ করতে পারে।

পাথরঘাটা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার টিএম শাহ আলম বলেন, শিশু শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ছে এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। পারিবারিক সমস্যা, আর্থিক সমস্যাসহ নানাবিধ সমস্যার কারণে ঝড়ে পড়ে, কিছু কিছু শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে মাদরাসাগামি হয়।  

তিনি আরও বলেন, ঝড়েপড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষামুখী করতে সচেতনতার বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি সকলের সমন্বয় এগিয়ে আসতে হবে। সচেতন‌ করতে আমরা মা সমাবেশ করে থাকি।

মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ, ২০২৩

২৫ নির্দেশনা পালনে যত্নবান হবেন কি ডিসিরা

শফিকুল ইসলাম খোকন
:শফিকুল ইসলাম খোকন:

একটি পরিবার যেমন কিছু নিয়ম-নীতির মধ্য দিয়ে চলে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রও সংবিধান, আইন, নীতিমালা, বিধি দিয়ে পরিচালিত হয়ে থাকে। আর ওই রাষ্ট্রের প্রধান বা সরকার প্রধানের কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও মেনে চলতে হয়। একটি রাষ্ট্রের আইন ও সরকারের সঠিক নির্দেশনা প্রয়োগ, বাস্তবায়ন করেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কিন্তু এমন নির্দেশনা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে অনেকাংশে অনিহাই দেখা গেছে। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে ‘আদালতের নির্দেশনা মানছেন না আমলারা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং প্রধানমন্ত্রীর ডিসিদের ২৫ দফা নির্দেশানায় কিছুটা আছ করা যাচ্ছে।

২৪ জানুয়ারি সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, গুজব, খাদ্যে ভেজাল, সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, জনগণকে সরকারি সেবা প্রধান, খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ২৫টি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। জনগণ ট্যাক্স দেয় সেবা পাওয়ার জন্য। সেবা দেওয়া প্রতিটি সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব। সে জন্য সেবার মনোভাব নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে দায়িত্ব পালন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণসহ ২৫টি নির্দেশনা বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জেলা প্রশাসকদের কিছু বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার পরামর্শ দেন। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে। নিয়মিত নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা বাড়াতে হবে। সুইচগেট বা অন্য কোনো কারণে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতার জন্য যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। সেবাপ্রত্যাশীদের সন্তুষ্টি অর্জনই যেন হয় সরকারি কর্মচারীদের ব্রত। প্রধানমন্ত্রী তার ২৫ দফাদার মধ্যে ১৯ দফায় সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, পাহাড়, প্রাকৃতিক জলাশয় প্রভৃতি রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং ২০ নং দফায় নিয়মিত নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা বাড়াতে হবে। সুইচগেট বা অন্য কোনো কারণে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতার জন্য যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারি তহবিল ব্যবহারে কৃচ্ছ্র সাধন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠদান কার্যক্রমের মানোন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে জেলা প্রশাসকদের। জেলা প্রশাসক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যের দাবিদার। জেলা প্রশাসকরা জেলা পর্যায়ে সরকারের চোখ এবং কান হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও জনসেবায় সরকারের কর্মপরিকল্পনা কতটা সফল হবে তা জেলা প্রশাসকদের যথাযথ পদক্ষেপ ও নজরদারির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। চলতি জেলা প্রশাসক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের এক বছর আগে। করোনাভাইরাস ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব যখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন এমন এক দুঃসময়ে।

আমাদের গ্রামে প্রবাদ আছে, তা হলো- ‘শালিসী মানি তাল গাছটি আমার’। নির্দেশনা যতই থাকুক না কেন মানা না মানা তা আমার ব্যপার; কুষ্টিয়ার একটি আলোচিত ঘটনা, তা হলো আদালতের স্থগিতাদেশ থাকার পরও ১২৩ কোটি টাকার সম্পত্তি ১৫ কোটি টাকায় নিলামে বিক্রির ঘটনায় গত ১১ আগস্ট কুষ্টিয়ার ডিসি মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, এসপি মো. খায়রুল আলম ও সদর থানার ওসি মো. সাব্বিরুল আলমকে তলব করেন হাইকোর্ট। ডিসি সাইদুল ইসলাম ওইদিন আদালতে হাজির হলে তাকে সতর্ক করে বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি কেএম রবিউল হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, আপনারা চাকচিক্যময় জীবনযাপন করেন। কীভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করে থাকেন, সেটাও জানি। দুঃখজনক হলেও সত্য, ডিসি অফিসে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারেন না। সাধারণ মানুষ তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান না। আপনাদের অফিসের দরজা-জানালা মোটা পর্দায় আবৃত থাকে। যার কারণে মানুষ আপনাদের ছবি পর্যন্ত দেখতে পান না।’ আদালত বলেন, ‘আপনাকে সতর্ক করছি। এখন থেকে ডিসি অফিসের দরজা-জানালা খোলা রাখবেন, যেন জনগণ আপনাদের চেহারা দেখতে পান। আপনার দরজা-জানালায় ভারী পর্দা ব্যবহার করবেন না। কারণ ডিসি হলো সরকারের হার্ট। আপনাকে জনগণের জন্য সেভাবে কাজ করতে হবে।’

আদালত বলেন, ‘ডিসি অফিসে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নাই। আপনারা একটা দরখাস্ত পর্যন্ত রিসিভ করেন না। এখন থেকে কোনো ধরনের উন্নাসিকতা দেখাবেন না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভালো কাজ করলে দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে। কোথাও চুরি-ডাকাতি হচ্ছে, সরকারি সম্পত্তি দখল হয়ে যাচ্ছে- অভিযোগ না পেলে কি আপনি বসে থাকবেন? বসে থাকার সুযোগ নাই।’

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রীট পিটিশন নম্বর ১৩৯৮৯/২০১৬ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের দৈত বেঞ্চের রায়ে উল্লেখ করেন, ‘জনসাধারণের উপকারার্থে রাষ্ট্রের নিকট গচ্ছিত সম্পত্তিকে পাবলিক ট্রাষ্ট সম্পত্তি বলা হয়। পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র, সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র, নম নদী, খাল- বিল, হাওর-বাওর, ঝিল, সমুদ্র সৈকত, নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত, টিলা, বন এবং বাতাস পাবলিক ট্রাষ্ট সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত। এসব সম্পত্তি সকল নাগরিকের, কোন একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়। ভবিষ্যতে আরও অনেক বিষয় পাবলিক ট্রাষ্ট সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত হবে বিধায় এর সংজ্ঞা প্রদান করা সম্ভব নয়। পৃথিবীব্যাপী নতুন নতুন অনেক বিষয় পাবলিক ট্রাষ্ট সম্পত্তি হিসেবে প্রতিনিয়ত অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।

পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র, জলাভূমি, সমুদ্র, নদ-নদী, খাল, বিল, হাওর, সমুদ্র সৈকত, নদীর পাড়, বন এবং বাতাস প্রকৃতি প্রদত্ত উপহার, প্রকৃতি প্রদত্ত আশির্বাদ। এসবকে অবশ্যই সকলের নিকট বাধাহীন ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। এ সকল সম্পত্তি হয় সকলের নয়তো কারো নয়। পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র, সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র, নদ-নদী, খাল, বিল, হাওর, ঝিল, সমুদ্র সৈকত, নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত, টিলা, বন এবং বাতাস সাধারণ জনগণের মুক্ত এবং বাধাহীন ব্যবহারের জন্য রাষ্ট্র সংরক্ষণ বা ব্যবস্থাপনা করবেন। এখানে রাষ্ট্র অছি বা ন্যাসরক্ষক বা ট্রাটি হিসেবে তথা আইন সম্মত রক্ষাকারী বা পরিচালনাকারী হিসেবে উক্ত পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব- "বৈচিত্র, সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, বন, পাহাড়-পর্বত, টিলা ও বন্যপ্রাণী ইত্যাদি পাবলিক এই সম্পত্তি রক্ষ নিরাপত্তা বিধান এবং উন্নয়ন করবেন।’এসব সম্পত্তি হলো জনগণের ন্যাস সম্পত্তি তথা জাতীয় সম্পত্তি। বরগুনার পাথরঘাটায় খাল ভরাটি জমি পাথরঘাটা কলেজ প্রকাশ্য দিবালোকে ঘর উত্তোলন করলেও ওই সম্পত্তি ‘এ সকল সম্পত্তি হয়সকলের নয়তো কারো নয়’ উচ্চাদালতের নির্দেশনা না মেনেই কাজ করা হয়েছে। প্রশাসনের নজরে আনার চেষ্টা করলেও কোন কাজের কাজ হয়নি। ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ইউএনও। এ রকমের একটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোন কাজ সম্পাদিত করতে হলে অবশ্যই সভায় সভাপতির উপস্থিতিতে সিদ্ধান্তের আলোকেই হয়ে থাকে। তাহলে কিভাবে একজন ইউএনও সরকারি খাস সম্পত্তিতে ঘর উত্তোলনের অনুমতি দেয়? আর কিভাবে একজনের সঠিক প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ডিসিআর প্রদান করে? খাল ভরাটি জমি অকৃষি খাস জমি বলে দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য পাথরঘাটা পৌরসভা জনস্বার্থ বিঘ্নিত হবেন না মর্মে অনাপত্তিপত্রও দিয়েছেন। তাহলে স্থানীয় সরকারের কাজই বা কি? যেখানে স্থানীয় পর্যায় নাগরিকদের সকল ধরণের সুযোগ-সুবিধা এবং নাগরিক সেবা নিশ্চিতের দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের। তাহলে এ দিয়ে কি বুঝা যাচ্ছে, যেখানে এসকল সম্পত্তির রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রশাসনের এবং প্রাপ্যতার দিক থেকে রেকর্ডীয় ও কবলা সম্পত্তির মালিক, মালিকানা হিসেবে দাবিদার অথচ তাদের প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। নদী রক্ষা কমিশন থেকে ওই সম্পত্তি উদ্ধারের ব্যপারে ডিসিকে লিখিতভাবে অবহিত করলেও কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। দেশের নদী রক্ষা, জলালয় ও খাস সম্পত্তি সংরক্ষণ এবং নদী দখল রোধে সরকার ও উচ্চাদালতের কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ডিসিরা মানছেন না। আদালতের নির্দেশনার পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব ও কার্যাবলী-২০১১ প্রজ্ঞাপনের ১৫ দফায় সম্পত্তি অধিগ্রহণ এবং হুকুম দখলের সুস্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে ডিসিদের ওপর।

পরিশেষে বলতে চাই, একটি গণতান্ত্রিক দেশ গণতান্ত্রিক পন্থায় পরিচালিত হয়ে থাকে আর আইন ও সরকারের সঠিক নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী অর্থাৎ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। আমাদের বিশ্বাস জেলা প্রশাসক সম্মেলন থেকে পাওয়া দিকনির্দেশনাগুলো জেলা পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা সফলভাবে বাস্তবায়ন করলে সরকারের পক্ষে বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা সহজ হবে। স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় প্রশাসন যৌথভাবে নাগরিকদের সকল ধরণের সেবা নিশ্চিতে একসাথে কাজ করবেন এটাই একজন নাগরিক হিসেবে প্রত্যাশা করছি। তাতেই দেশবাসীর জন্য বয়ে আনবে স্বস্তি।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

প্রকাশিতঃ দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, নয়া শতাব্দি, প্রতিদিনের বাংলাদেশ, সারাবাংলা ডটনেট

নদী মরলে দেশও মরবে

: শফিকুল ইসলাম খোকন : নদীমাতৃক দেশে নদীই আমাদের ভরসা। নদী আমাদের হৃৎপিণ্ড, নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না, প্রকৃতি বাঁচবে না, পরিবেশের সুরক্ষা ...