: শফিকুল ইসলাম খোকন :
নদীমাতৃক দেশে নদীই আমাদের ভরসা। নদী আমাদের হৃৎপিণ্ড, নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না, প্রকৃতি বাঁচবে না, পরিবেশের সুরক্ষা হবে না, এমনকি টেকসই উন্নয়নও সম্ভব নয়। নদীগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও নদী রক্ষায় আমাদের তেমন কোনো জোরালো ভূমিকা বা কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত ‘রামসার কনভেনশন ১৯৭১’ এবং ‘রিও কনভেনশন ১৯৯২’ স্বাক্ষর করায় ভূমি ও জলজ পরিবেশ রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ কনভেনশন দুটির প্রথমটি জলজ পাখির আবাস সংরক্ষণসংক্রান্ত, যা নদী ও জলাভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষার ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয়। দ্বিতীয়টি ভূমি ও জলের সব প্রজাতির উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসংক্রান্ত, যা একই লক্ষ্যে অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের টাঙ্গুয়ার হাওড় ও সুন্দরবন এলাকা ‘রামসার সাইট’ হিসাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। হাকালুকি হাওড় এবং সুন্দরবনকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ‘পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকা’ ঘোষণা করায় ওই দুই এলাকার নদী ও জলাভূমিগুলো সংরক্ষণের বেলায় সরকারি দায়বদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু এখনই আমাদের দেশের আরও অনেক জলাভূমিকে ‘রামসার সাইট’ হিসাবে এবং ‘পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকা’ হিসাবে ঘোষণা করা উচিত।
সারা দেশেই আগ্রাসী থাবায় নদীগুলো বিপর্যস্ত। যে কোনো নদীর পাড়ে চোখ মেলে তাকালেই দখলবাজির চিত্র স্পষ্ট দেখা যায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, অনেক নদ-নদীর অস্তিত্বই এখন হুমকির সম্মুখীন। অনেক নদী ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে। দখল ও দূষণের কারণে গত ৪ দশকে দেশের ৪০৫টি নদ-নদীর মধ্যে বিলুপ্ত হওয়ার পথে ১৭৫টি। বাকি ২৩০টিও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ কমে হয়েছে ৬ হাজার কিলোমিটারের মতো। কৃষি, যোগাযোগ, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মানুষের জীবনযাত্রা সবকিছুর জন্যই এটা ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। নদী-জলাশয় রক্ষার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিবেশ সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো, একেবারে শীর্ষ থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের পদাধিকারীরা নানা কথা বলে চলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আদালতের নির্দেশেও খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।
সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন নদীর পানিতে ১১ ধরনের ক্ষতিকর ধাতুর দেখা মিলেছে। গবেষণায় যেসব নদী, হ্রদ বা খালের দূষণের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ব্রহ্মপুত্র, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বংশী, ধলাই বিল, মেঘনা, সুরমা, কর্ণফুলী, হালদা, খিরু, করতোয়া, তিস্তা, রূপসা, পশুর, সাঙ্গু, কাপ্তাই লেক, মাতামুহুরী, নাফ, বাকখালি, কাসালং, চিংড়ি, ভৈরব, ময়ূর, রাজখালি খাল। আর এসব জলাধারের পানিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে জিংক, কপার, আয়রন, লেড, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, কার্বন মনোক্সাইড ও মার্কারির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, গত ৪০ বছরে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ আশপাশের অবিচ্ছিন্ন নদীগুলো চরম মাত্রার দূষণের শিকার হয়েছে। বরিশালের কীর্তনখোলা, বরগুনার খাকদোন নদীও দিন দিন মরে যাচ্ছে। নদীগুলো যে দখলই হচ্ছে তা নয়, শিল্পবর্জ্যরে ভারী ধাতু পানিতে মিশে নদীর তলদেশে মারাত্মক দূষণ তৈরি করে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে নদীর পানিতে ক্ষতিকর ধাতুর ঘনত্ব বেশি পাওয়া যায়।
সবশেষে দেশে নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে ২০১৯ সালে তালিকা প্রণয়ন শুরু করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি)। প্রায় চার বছর কাজ শেষে গত ১০ আগস্ট সংস্থাটির ওয়েবসাইটে ৯০৭টি নদ-নদীর খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন নদী গবেষকরা। এমনকি সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত নদ-নদীর তথ্যের সঙ্গেও এনআরসিসির খসড়ার তথ্য মিলছে না।
এদিকে দেশের ৪০৫টি নদ-নদী নিয়ে ২০১১ সালে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এ নিয়ে ছয় খণ্ডের বইও প্রকাশ করেছিল সংস্থাটি। ওই ৪০৫টি নদ-নদীর মধ্যে ১৩৯টিই এনআরসিসির খসড়া থেকে বাদ পড়েছে। ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ নামে ছয় খণ্ডে প্রকাশিত ওই সিরিজের সঙ্গে এনআরসিসির খসড়া তালিকার নদ-নদীর তথ্যে ব্যাপক গরমিল আছে বলে দাবি করেছে নদীবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, পাউবোর সমীক্ষার অন্তত ১৩৯টি নদীর নাম এনআরসিসির খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের আমরি, ইসদার, উমিয়াম, কর্ণঝরা, কর্ণবালজা, কাঁচামাটিয়াসহ ২৭ নদীর নাম তালিকাভুক্ত করেনি এনআরসিসি। একইভাবে রাজশাহী বিভাগের ১৬, রংপুরের ১০, ময়মনসিংহের ২৭, বরিশালের সাত, ঢাকার ৩০, চট্টগ্রামের ১২ ও খুলনা বিভাগের ১০টি নদী তালিকাভুক্ত করেনি এনআরসিসি।
থ্যে খুবই সহজেই অনুমেয় কী হচ্ছে নদী নিয়ে। আসলেই কি দেশের পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করা হচ্ছে? টেকসই উন্নয়নে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। গবেষণায় জানা যায়, ২০০৯ সালে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহৃত হয়েছে ৬৮ বিলিয়ন টন। ২০৫০ সালে ব্যবহৃত হবে ১৪০ বিলিয়ন টন, যা পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করবে। মানুষের কারণে ২০ শতাংশ চাষযোগ্য জমি, ৩০ শতাংশ বনভূমি এবং ১০ শতাংশ চারণভূমি হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশে আবাসন ও শিল্পায়নের কারণে প্রতি বছর ১ শতাংশ কৃষিজমি কমছে। জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হচ্ছে। অর্ধেকেরও বেশি নদী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকিগুলো দখলে বিপর্যস্ত। টেকসই উন্নয়নের জন্য যে অর্থনীতি আমাদের প্রয়োজন, সেই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে নদীকে তার হারানো গৌরব ও যৌবন ফিরিয়ে দিতে হবে। নদী আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। টেকসই উন্নয়ন ও নদী রক্ষায় সবাইকে নিয়েই সামনে এগোতে হবে। নদীর ব্যবহার এখন বহুমাত্রিক। মানুষ বুঝে না বুঝে নদীকে ব্যবহার করছে। নদীর কাছেই গড়ে উঠেছে বড় বড় কল-কারখানা, নদীতে এখন হাজার হাজার লঞ্চ-স্টিমার। নদীতে শত শত বাঁধ। নদী দখল, নদী দূষণসহ যখন যেভাবে প্রয়োজন, তখন সেভাবেই নদীকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিটি জেলায় নদী রক্ষা কমিটি রয়েছে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে। তাদের কাজ কী? তারা আসলে কী করে? নদী ভরাট ও অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে সবাইকে নিয়ে কাজ করছে এই কমিটি, নদী খননের প্রশাসনিক কার্যাদি সম্পাদন ও নদী রক্ষায় নানা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কাজও করছে এ কমিটি। কিন্তু শুধু জেলা প্রশাসন অথবা পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী বাঁচাতে পারবে না। ডিসিদেরও সরকারসহ উচ্চাদালত থেকে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তাদের নীরব ভূমিকা দেখা গেছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষমতাসীন দলের নেতাদেরও অন্যতম ভূমিকা রয়েছে। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি সরকারকে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলোর কাজের গতি ত্বরান্বিত করতে হবে। আবার এসব কাজের জবাবদিহি বাড়াতে হবে। দেশের নদী রক্ষা, জলাশয় ও খাস সম্পত্তি সংরক্ষণ এবং নদী দখল রোধে সরকার ও উচ্চাদালতের কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ডিসিরা তা মানছেন না। আদালতের নির্দেশনার পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব ও কার্যাবলি-২০১১ প্রজ্ঞাপনের ১৫ দফায় সম্পত্তি অধিগ্রহণ এবং হুকুম দখলের সুস্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে ডিসিদের ওপর।
নদী ও জলাশয়ে রয়েছে অনেক সম্পদ। কথায় বলে, পরিবেশ বাঁচলে দেশ বাঁচবে, দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচব। আমাদের অসচেতনতার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। জীবনধারণের স্থান ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নিজ উদ্যোগে, নিজের স্বার্থে নদীকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সবাই সচেতন না হলে শুধু আইন প্রয়োগে খুব বেশি সফলতা আসবে না। পরিবেশকে বিবেচনায় না রেখে একটি সুন্দর পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। পরিবেশ আর উন্নয়নের মধ্যকার সম্পর্ক পরস্পরবিরোধী নয়। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশের রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক। পরিবেশকে রক্ষা করে দেশের উন্নয়ন না করলে তা টেকসই হবে না। এজন্য শুধু সরকার বা বিভিন্ন সংস্থাকে কাজ করলে চলবে না, সমাজের প্রত্যেক মানুষকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করত হবে। পরিবেশ বাঁচিয়েই অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সম্ভব করতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, মানুষ যেমন হৃৎপিণ্ড না থাকলে বাঁচে না, তেমনি নদী না থাকলে দেশও বাঁচানো সম্ভব নয়। যেভাবে নদী মরছে, আর যেভাবে নদীগুলো কাঁদছে, তাতে একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে দেশ। একটি দেশকে বাঁচাতে হলে এবং টেকসই উন্নয়ন করতে হলে নদীগুলো সংরক্ষণ করার বিকল্প নেই। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি। দেশ রক্ষা, পরিবেশ সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে মুক্তির জন্য নদী ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
শফিকুল ইসলাম খোকন : গবেষক ও লেখক
msi.khokonp@gmail.com
সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর, তারিখঃ ২৪ সেপ্টে¤¦র ২০২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন