:: শফিকুল ইসলাম খোকন ::
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক]
গত ৫ মে দৈনিক আমাদের অর্থনীতিতে একটি কলাম লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল ‘স্বস্তির রাজনীতি : ঐকমত্যের দেশপ্রেম’। সাভার ট্র্যাজেডির দিন থেকে সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাতে এক রকমের রাজনীতিতে স্বস্তির হাওয়া বইতে শুরু করছিল। একে অপরের প্রতি যে সহানুভূতি বিরাজ করছিল তাতে মনে হয়েছিল রাজনীতিতে ছোটখাটো ছাড়া হয়তো পূর্বের ন্যায় সহিংস ঘটনা আর ঘটবে না। এ কারণেই ওই লেখাটি লিখেছিলাম। লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর আমার বন্ধুমহল থেকে শুরু করে অনেক শুভাকাক্সক্ষী লেখাটি পড়ে অনেক প্রশংসা করেছিলেন এবং ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংলাপ আর বিরোধী দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চায়ের দাওয়াত’ আমাদের গোটা জাতিকে একটি নতুন মেরুকরণের দিকে নিতে শুরু করেছিল। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম বেঁধে দেয়। তাতে আবার নতুন করে রাজনীতিতে সহিংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি শুরু হয়ে যায়। এর পরদিন ৫ মে হেফাজতে ইসলাম ঢাকার মতিঝিলে অবরোধের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে বিশাল জনস্রোত দেখিয়ে দেয়। তাতে হয়ে গেল নজিরবিহীন ঘটনা।
প্রতিনিয়তই চলছে ঘটনা, দুর্ঘটনা অথবা ট্র্যাজেডি; যে নামেই বলি না কেন। একে একে ঘটনা দুর্ঘটনা এবং ট্র্যাজেডিতে কান্তি এসেছে মানুষের মাঝে। কান্তি মানসিকতা নিয়ে আর যেন কোনো কিছুই পারছে না মানুষ। একটি ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি ঘটনা। এসব ঘটনা দুর্ঘটনা চেপে ধরেছে আমাদের গোটা জাতিকে। একটি ঘটনা শুরু হলে আর এক ঘটনায় চাপা পড়ে যায়। ইতিপূর্বে দেখে আসছি শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প, গ্রামীণ ব্যাংক, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনিসংকেত, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, জাতীয় সংসদ ও বিচারবিভাগের মধ্যে নতুন করে সৃষ্ট বিতর্ক, খুন, গুম, অপহরণ, দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় অস্থিরতা, পিলখানা ট্রাজেডি, বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু, তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড, শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ, কক্সবাজারে কয়েকশ গাড়িতে আগুন দিয়ে পোড়ানো, সাভার ট্র্যাজেডি সব শেষে হেফাজতের অবরোধ। এসকল ইস্যুগুলো সামাল দিতে সরকারকে বর্তমানে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। সরকারের শেষ বছরে এসে এতগুলো ইস্যু সামাল দিতে সরকারের হিমশিম খেতে হচ্ছে। হেফাজতের গত মাসের লংমার্চ তেমন কোনো সহিংসতা ছাড়া বেশ ভালোভাবেই কাটিয়েছিল। কিন্তু ৫ মে যে ঘটনা ঘটে গেল তা নজিরবিহীন। যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ বা প্রচার করেছে।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে আন্দোলন-সংগ্রাম, সংকট হতেই পারে। আবার তা যে নিরসন হবে না এমনটিও নয়। কিন্তু ‘দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতাদের কপটতা, ক্ষমতার লোভ ও ব্যক্তিস্বার্থের কারণে দেশটি ক্রমে অন্ধকারের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দেশবিরোধী অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। যা কখনো, কোনো পক্ষের জন্যই শুভ হতে পারে না। শুভ হতে পারে না দেশ ও জনগণের জন্যও। এদেশে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে সৃষ্ট জনরোষ থেকে রাজনৈতিক নেতারাও রেহাই পাবেন না।
২৪ এপ্রিল ঘটে যাওয়া সাভার ট্র্যাজেডির শোক এখনো মুছে যায়নি। মুছে যায়নি স্বজনহারার ক্ষত। প্রতিনিয়ত কম-বেশি সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে শ্রমিকদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হচ্ছে গলিত অথবা বিকৃত। কেউ কেউ বলছে সাভার ট্র্যাজেডি একটি নিছক দুর্ঘটনা। এটি তেমন কোনো বড় দুর্ঘটনা নয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাভার ট্রাজেডি নিয়ে বলেছিলেন ‘নট রিয়েলি সিরিয়াস’। তার মতে সাভার ট্রাজেডি মারাÍক কিছু নয়। এটি নিছকই একটি দুর্ঘটনা। (সূত্র : দৈনিক আমাদের অর্থনীতি, ৫ মে ২০১৩)। বড় আফসোস লাগে, এতগুলো শ্রমিকের প্রাণহানি হল, কিন্তু আমাদের (ওইরকম রাজনীতিবিদদের) মনে এতটুকুও নাড়া দেয়নি। সাভার ট্র্যাজেডির ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই বিরোধী দলের ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম, হেফাজত ইসলামের অবরোধ আর সরকারদলীয় কিছু নেতা-মন্ত্রীর উস্কানিমূলক কথা, নতুন করে সংঘাত শুরু হয়ে গেল। এই ক্রান্তিলগ্নে প্রধানমন্ত্রীর সংলাপের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে বিরোধী দলের ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম, বুধ ও বৃহস্পতিবার হরতাল এবং হেফাজতের অবরোধ মানবিক কারণে বিরত থাকা উচিত ছিল। কিন্তু ৫ মে হেফাজতের অবরোধকে কেন্দ্র করে দিনের বেলা যা ঘটে গেল তা অন্যান্য রাজনীতিবিদদের দ্বারাও ঘটেছিল, কিন্তু কোরআন শরিফে আগুনÑ এটি দুঃখজনক এবং ক্ষমার অযোগ্য। এ ঘটনা হেফাজত করুক আর সরকারদলীয় ক্যাডার অথবা অন্য কোনো দলের ক্যাডার ছদ্মবেশী হয়ে ঢুকে করুকÑ এটি ক্ষমার অযোগ্য, ওদের ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই।
ওইদিন রাতে যা ঘটে গেল তা নজিরবিহীন ঘটনা। র্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয় যৌথ অভিযানে যা ঘটে গেল তা আমরা সবাই অবগত। ওইদিন রাত ১১টার দিকে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর’র পর্দায় লাইভ শোতে টিভির স্টুডিওতে দর্শকদের উদ্দেশে এক সাংবাদিক বলেছিলেন ‘কিছুক্ষণ আগে একটি ম্যাসেজ এলো আমাদের এখান থেকে সরে যেতে হবে। কারণে তিনি উত্তর দিলেন আমাদের (সাংবাদিকদের) নিরাপত্তা নেই।’ এরপর রাত ২টার দিকে যৌথবাহিনী শাপলা চত্বরে নৃশংস হামলা চালায়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা শাপলা চত্বরের ঘটনাটি ২৫ মার্চ কালরাতের চেয়ে কম নয়। শাপলা চত্বর থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের সরিয়ে দেয়া স্বাধীন গণমাধ্যমগুলোর কণ্ঠরোধ করে রাখা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এটি স্বাধীন দেশের স্বাধীনচেতাদের কাছ থেকে অবশ্যই কাম্য ছিল না।
এদিকে হেফাজতে ইসলামের সমর্থক ও প্রতিবাদকারীদের উপর হামলাকে ‘প্রতিবাদকারীদের গণহত্যা’ বলে নিন্দা জানিয়েছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন। ‘বিবৃতিতে বলা হয়, ৬ মে ভোর ৩টায় প্রতিবাদকারীদের উপর সিরিজ হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে বলা হয়, প্রতিবাদকারীদের উপর হামলায় হতাহতের সঠিক সংখ্যা এখনই বলা সম্ভব নয়। দেশটির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন ধরনের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। কিছু কিছু ইন্টারনেটের খবরে নিহতের সংখ্যা ২ হাজার ৫০০ বা এর বেশি বলা হয়েছে। ইন্টারনেটে নিহতদের লাশের ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে। তবে দেশের প্রধান সংবাদ মাধ্যমগুলো হতাহতের বিষয়ে নিশ্চুপ রয়েছে। প্রতিবাদকারীদের উপর হামলার দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচারকারী দুটি চ্যানেল তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) জানতে পেরেছে বিজিবি, পুলিশ ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সোমবার সকাল থেকে হেফাজতে ইসলামের প্রতিবাদকারীদের উপর বিভিন্ন স্থানে কঠোরভাবে চড়াও হয়েছে। গণহারে ধড়পাকড় করছে।’ (সূত্র : আমাদেরসময়ডটকম, ৭ মে ২০১৩)। এই নজিরবিহীন ঘটনা আমাদের দেশের মিডিয়া কিছুটা এড়িয়ে গিয়েছে এটি দুঃখজনক। তবে ধিক্কার জানাই সরকারের প্রতি এসব ঘটনা প্রচার করার অপরাধে সংশিষ্ট গণমাধ্যগুলোর সম্প্রচার বন্ধ করার জন্য। পদে পদে সরকার গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করছে।
হেফাজতের দাবি মতে, হেফাজত কোনো রাজনৈতিক দল নয়। একটি সামাজিক সংগঠন। আর একটি সামাজিক সংগঠন স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত যেকোনো দাবি উত্থাপন করতেই পারে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে নবী (সা.)-কে অবমাননা বগারদের শাস্তির দাবিতে বাংলাদেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। হেফাজতে ইসলামের প্রতিবাদকারীদের দাবি, সরকার নাস্তিকদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। এসব বিষয়ের প্রতিবাদে ও বাসফেমি আইনের দাবিতে ১৩ দফা নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে হেফাজতে ইসলাম। সেসব দাবির পক্ষে ঢাকায় অবরোধ ও সমাবেশ করতে গেলে এমন ন্যক্কারজনক হামলার শিকার হন তারা। হেফাজত ইসলামের অবরোধকে কেন্দ্র করে জ্বালাও-পোড়াও থেকে শুরু করে সহিংস ঘটনা ঘটেছে তা সত্যিকার অর্থে কাম্য নয়। আর অবরোধের দিন রাতে যে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে গেলে সেটিও কাম্য নয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের মতে শাপলা চত্বরে নিষ্ঠুর ও অমানবিকভাবে হামলা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমন সব অস্ত্র ব্যবহার করেছে যা সাধারণত সম্মুখ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। বার্তাসংস্থা এএফপি বলছেÑ চার দশক আগে স্বাধীনতার পর এটাই বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা। সিএনএন জানিয়েছে, এতে ঠিক কতজন নিহত হয়েছে, তা সম্ভবত কখনো জানা যাবে না।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশ ব্যাপক সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভেবে জনমনে উৎকণ্ঠা বিরাজ করা অস্বাভাবিক নয়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা প্রশ্নে রাজনৈতিক সংকট দূর হয়নি এখনো। আমরা লক্ষ করেছি, সরকার রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও বিএনপি শর্তারোপ করে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। অপরদিকে সরকার পতনের আন্দোলনে কর্মী-সমর্থকদের হেফাজতের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। এসব বিবেচনায় বিএনপির এ নীতি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে জিইয়ে রাখার প্রবণতা বলে মনে করারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সুতরাং উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার আগেই উভয় রাজনৈতিক দলকে দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। সহিংস সংঘাতের রাজনীতি বাদ দিয়ে সমঝোতার দিকে এগিয়ে আসুন। দেশবিরোধী যেকোনো ধরনের ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নিন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন