শফিকুল ইসলাম খোকন

বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১৮

কাঠমান্ডুতে বিমান দুর্ঘটনা একটি শোকাবহ অধ্যায়

শফিকুল ইসলাম খোকন
যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় 'স্বজন হারানোর বেদনা কত কষ্টের?' উত্তর আসবে এর চেয়ে কষ্টের কিছুই নেই। পিতা-মাতার সামনে সন্ত্মানের মৃত্যু আর সন্ত্মানের সামনে পিতা-মাতার মৃত্যু- এর চেয়ে কষ্ট এ পৃথিবীতে আর নেই। বিমান দুর্ঘটনায় যারা মারা গেছেন, এটিও তেমনি কষ্টের; তারা কোনো না কোনো পরিবারের স্বজন। এখন পরিবারের স্বজন আর নেই, এখন আমাদের স্বজন, বাংলাদেশের স্বজন, মানবতার স্বজন, মানবিকতার স্বজন। তাদের জন্য এখন গোটা বাংলাদেশ কাঁদে, বাংলাদেশের মানুষ কাঁদে।
বাংলাদেশের বেসরকারি মালিকানাধীন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের বিএস-২১১ একটি উড়োজাহাজ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্ত্মর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত্ম হয়ে নারী-শিশুসহ কমপক্ষে ৫০ জন নিহত হয়। উড়োজাহাজটিতে ৭১ আরোহীর মধ্যে ৬৭ জন ছিল যাত্রী, বাকি চারজন ক্রু। পাইলট-ক্রুসহ আরোহীদের ৩৬ জন বাংলাদেশি, ৩৩ জন নেপালের এবং একজন করে যাত্রী ছিল চীন ও মালদ্বীপের। ৩৬ বাংলাদেশির মধ্যে ৯ জন কাঠমান্ডুর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ২৫ জন বেঁচে নেই।  নেপালের স্থানীয় সময় ১২ মার্চ সোমবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটে বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত্ম হয় ও আগুন ধরে যায়। দ্রম্নত ঘটনাস্থলে বিমানবন্দরের উদ্ধারকারী দল, নেপাল সেনাবাহিনী, পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্স ছুটে যায়। দুর্ঘটনার পর ত্রিভুবন আন্ত্মর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামা বন্ধ রাখা হয়। যান্ত্রিক ত্রম্নটির কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, রাডারের ভুল সিগন্যাল পেয়ে পাইলট উড়োজাহাজ অবতরণ করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ যার বিরম্নদ্ধেই হোক, অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ এবং বিচারের আওতায় আনা জরম্নরি। কিন্তু এ মুহূর্তে আহতদের দ্রম্নত চিকিৎসা এবং নিহতদের স্বজনদের কাছে পৌঁছানো ও ক্ষতিপূরণ দেয়াটা তার চেয়ে বেশি জরম্নরি। 
বিশ্বের ইতিহাসে অনেক বিমান দুর্ঘটনা হয়েছে। সেই দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানিও হয়েছে। আর বিমান দুর্ঘটনার সবচেয়ে পতিত হয়েছে এবং সবচেয়ে বেশি পরিচিত নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দর। এর আগেও আরও বহু বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। পাহাড় ঘেরা এই বিমানবন্দরটি কাঠমান্ডু উপত্যকায় এবং শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে। একের পর এক বিমান দুর্ঘটনার কারণে এই বিমানবন্দরটির নিরাপত্তা নিয়ে প্রায়শই আলোচনা হয়। বিমানবন্দরটিতে প্রথমবারের মতো আন্ত্মর্জাতিক কোনো বিমান অবতরণের পর থেকে এ পর্যন্ত্ম ৭০টিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। বলা হচ্ছে, এসব দুর্ঘটনায় ৬৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। বিমানের পাশাপাশি সেখানে হেলিকপ্টারও বিধ্বস্ত্ম হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে বিমান দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়। যারা আন্ত্মর্জাতিক খবরের পাঠক তারা হরহামেশাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছোট-বড় বিমান দুর্ঘটনার খবর পড়েন বা দেখেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যাত্রীবাহী বিমান দুর্ঘটনার খবর কমই বলা চলে। কালেভদ্রে প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় অনেকে নিহত হলেও যাত্রীবাহী বিমান দুর্ঘটনার ঘটনা হাতেগোনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৮৪ পর এটাই সবচেয়ে বড় বিমান দুর্ঘটনা। যা ১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট ১৯৮৪ ঢাকায় খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে অবতরণ করার সময় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফকার এফ২৭-৬০০ জিয়া আন্ত্মর্জাতিক বিমানবন্দরের (শাহজালাল আন্ত্মর্জাতিক বিমানবন্দর) কাছাকাছি একটি জলাভূমির মধ্যে বিধ্বস্ত্ম হয়। বিমানটি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে জিয়া আন্ত্মর্জাতিক বিমানবন্দরে পূর্বনির্ধারিত ঘরোয়া যাত্রী ফ্লাইট পরিচালনা করছিল।
বাংলাদেশের বিমান দুর্ঘটনা : বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট ও উইকিপিডিয়ার বরাতে জানা যায়, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে যাত্রীবাহী বিমান যাত্রা শুরম্ন করে। এরপর ১৯৮৪ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফকার এফ২৭-৬০০ এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটায়। এতে নিহত হন বিমানে থাকা ৪৯ জন। এর মধ্যে বিমানের যাত্রী ছিলেন ৪৫, বাকিরা ওই বিমানের ক্রু। এরপর ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে আবারও দুর্ঘটনার শিকার হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিমান। এবারের ঘটনাস্থল সিলেট ওসমানী আন্ত্মর্জাতিক বিমানবন্দর। জরম্নরি অবতরণের সময়ে 'ফকার এফ২৮' মডেলের বিমান কুয়াশার কারণে রানওয়ের পাশের ধানক্ষেতে পড়ে। এতে বিমানটি মাঝখান থেকে দু'ভাগ হয়ে গেলেও কেউ নিহত হননি। বিমানে থাকা ৮৫ যাত্রীর মধ্যে আহত হন ১৭ জন। এরপরে ২০০১ সালে আবারও সিলেট বিমানবন্দরে কুয়াশার কারণে একই বিমান পরিচালন সংস্থার একই মডেলের বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে। তবে এবারও কেউ নিহত হননি। ২০০৪ সালের ৮ অক্টোবর আবারও সিলেট বিমানবন্দরে দুর্ঘটনা ঘটে। এবারও আবার 'ফকার এফ২৮-৪০০০' মডেলের বিমান আলোচনায়। বিমানটি সেদিন প্রচ- বৃষ্টির মধ্যে নামতে গিয়ে রানওয়ে থেকে ছিটকে যায়। কিন্তু এতে বিমানের থাকা ৮৩ জনের মধ্যে ৮ যাত্রী আহত হন। ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি সিলেট ওসমানী আন্ত্মর্জাতিক বিমানবন্দরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে আসা 'বিজি-৫২' বিমানের ইঞ্জিনে ঢুকে পড়ে একটি পাখি। এতে বিমানটি জরম্নরি অবতরণে বাধ্য হলেও কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। একই বছরের ৯ মার্চ কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণের সময় একটি কার্গো বিমান বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত্ম হয়। এতে বিমানের ৪ ক্রু প্রাণ হারান। সবশেষ ১২ মার্চ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্ত্মর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী বিমানটি বিধ্বস্ত্ম হলো। এতে ৫০ জনেরও বেশি আরোহী প্রাণ হারিয়েছেন।
দেশের বাইরে বিমান দুর্ঘটনা : আন্ত্মর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, দেশের বাইরে ২০১৪ সালের ৮ মার্চ মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ২৩৯ জন যাত্রী নিয়ে কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং যাওয়ার পথে হারিয়ে যায়। এখনো সেই বিমানের হদিস মেলেনি। এয়ার ফ্রান্স : বিমান হারানোর ঘটনা ঘটেছিল ২০০৯ সালের ১ জুনেও। সে সময় ব্রাজিল থেকে ফ্রান্স যাওয়ার পথে আটলান্টিক মহাসাগরে হঠাৎ করে হারিয়ে যায় এয়ার ফ্রান্সের একটি বিমান। প্রায় দু বছর পর সাগরের নিচে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় এর খোঁজ পাওয়া যায়, এতে ২২৮ যাত্রীর সবাই নিহত হন। বিমান চালানোর অত্যাধুনিক ব্যবস্থা কাজ না করায় বিমানটি দ্রম্নতগতিতে নিচে নেমে অ্যাটলান্টিকের পানিতে তলিয়ে যায় বলে পরবর্তীতে তদন্ত্ম রিপোর্টে জানা গেছে। ভোজা এয়ার : ২০১২ সালের ২০ এপ্রিল পাকিস্ত্মানের বেসরকারি 'ভোজা এয়ারে'র একটি বিমান ল্যান্ডিংয়ের সময় নামতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়লে ১২৭ যাত্রীর সবাই নিহত হন। বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে নামার চেষ্টাই দুর্ঘটনার কারণ বলে প্রাথমিক তদন্ত্মে জানা গেছে। বোয়িং ৭৩৭-২০০ বিমানটি করাচি থেকে ইসলামাবাদ যাচ্ছিল। ইরান এয়ার : ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি ইরান এয়ারের একটি বোয়িং ৭২৭-২০০ বিমান তেহরান থেকে অরম্নমিয়ে যাওয়ার পথে নামতে গিয়ে খারাপ আবহাওয়ার কারণে দুর্ঘটনায় পড়লে ১০৫ জন যাত্রীর মধ্যে ৭৭ জন নিহত হন। বেঁচে যায় ২৮ জন। এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস : দুবাই থেকে ভারতের ম্যাঙ্গালোর বিমানবন্দরের রানওয়েতে নামার পর এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের একটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ বিমান রানওয়ে থেকে ছিটকে দূরের পাহাড়ে গিয়ে আঘাত করলে বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। এতে ১৫৮ জন নিহত হন। আর বেঁচে যান আটজন। পাইলটের গাফিলতি দুর্ঘটনার কারণ বলে তদন্ত্মে জানা যায়। ঘটনাটি ঘটে ২০১০ সালের ২২ মে। আফ্রিকিয়া এয়ারওয়েজ : পাইলটের ভুলের কারণে ২০১০ সালের ১২ মে আফ্রিকিয়া এয়ারওয়েজের একটি বিমান লিবিয়ার ত্রিপোলিতে ল্যান্ডিংয়ের আগে দুর্ঘটনায় পড়লে ১০৩ জন যাত্রী নিহত হন। তবে অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে যায় হল্যান্ডের নয় বছরের এক ছেলে! প্রেসিডেন্টের মৃত্যু : ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল পোল্যান্ডের বিমানবাহিনীর একটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়লে দেশটির সে সময়কার প্রেসিডেন্টসহ ৯৬ জন যাত্রীর সবাই নিহত হন। পোল্যান্ডের সরকারি তদন্ত্ম প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার জন্য পাইলটকে দায়ী করা হয় বলা হয়, খারাপ আবহাওয়ায় ল্যান্ডিং এর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছিল না পাইলটের। ইয়েমেনিয়া : ল্যান্ডিং-এর আগে ইয়েমেনের এয়ারলাইন্স 'ইয়েমেনিয়া'-র একটি বিমান সাগরে ভেঙে পড়লে ১৫৩ জন যাত্রীর ১৫২ জনই মারা যান। শুধু বেঁচে যায় ১২ বছরের একটি মেয়ে দুর্ঘটনার কারণ পাইলটের 'ঝুঁকিপূর্ণ ম্যানুভার'।
বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে পরস্পর বিরোধ বক্তব্য যেমন শুরম্ন হয়েছে তেমনি নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্ত্মর্জাতিক বিমানবন্দরের দুর্ঘটনার সংখ্যা ইতিমধ্যে হিসাব কসা শুরম্ন হয়েছে। শুধু হিমালয়কন্যা নেপালে গত ৭ বছরেই ১৫টি ছোট-বড় পেস্নন ক্রাশের ঘটনা ঘটেছে। নেপালের জরিপ সংস্থা নেপাল ইন ডাটা অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত্ম এসব পেস্নন ক্রাশের ঘটনায় মোট ১৩৪ জন যাত্রী নিহত হয়েছেন। ওই ৭ বছরের প্রতি বছর কমপক্ষে একটি করে বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এ পর্যন্ত্ম আন্ত্মর্জাতিক কোনো বিমান অবতরণের পর থেকে এপর্যন্ত্ম ৭০টিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে শুধু এখানেই। এসব দুর্ঘটনায় ৬৫০ জনেরও প্রাণহানি ঘটে। নেপালে দুর্ঘটনার পর ৬ সদস্যের তদন্ত্ম টিম গঠন করা হয়েছে। 'বস্নাক বক্স' সংগ্রহ করা হয়েছে। দেখা যাক তদন্ত্ম টিম কি বলছে আর বস্নাক বক্স কি জানান দিচ্ছে। 
স্বজন হারানোর বেদনা সকলের আছে, সকলেই স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করেন। নেপালের এ দুর্ঘটনায় আমরা গোটা জাতি মর্মহত। এমন মর্মান্ত্মিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। 
শফিকুল ইসলাম খোকন: কলাম লেখক ও গবেষকসূত্রঃ দৈনিক যায়যায়দিন ও প্রতিদিনের সংবাদ, তারিখঃ ১৪ মার্চ ২০১৮

শুক্রবার, ৯ মার্চ, ২০১৮

আন্তর্জাতিক নারী দিবস : নারীর মতায়ন নিশ্চিত হলে স্থানীয় সরকার উন্নয়ন সম্ভব


শফিকুল ইসলাম খোকন
মানব সভ্যতাকে যদি পাখির সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে নারী ও পুরুষ হলো একটি পখির দুটো ডানা। একটি ডানা ভেঙে গেলে সভ্যতার পাখি উন্নতির আকাশে উড়তে পারে না। তাই কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় উচ্চারণ করেন, 'বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।' ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, '৫২'র ভাষা আন্দোলন, '৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ, '৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সর্বত্রই রয়েছে পুরুষদের পাশাপাশি নারীর সরব পদচারণা। এ উপমহাদেশের মানুষ কি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও ইলা মিত্রের বীরত্বের কথা ভুলতে পারবে কোনদিন? ভুলতে পারবে মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার কথা? না পারবো না। 

নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়দীপ্ত দিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ। বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ায় দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ১৯১০ সালে ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ৮ মার্চকে নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারপর থেকে দিনটি ঘটা করে পালন করা হতো সমাজতন্ত্রী শিবিরে। সোভিয়েত বিপ্লবের পর নারী দিবস সমাজতান্ত্রিক শিবিরে নারী মুক্তি আন্দোলনের অনুপ্রেরণাদায়ক দিন হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর থেকে প্রায় সব দেশেই দিনটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় মানবসমাজ কতটা এগোল সে বিশ্লেষণও করা হয় এই দিনে। বাংলাদেশে নারী উন্নয়নকে টেকসই উন্নয়নের পথ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। নারী-পুরুষ সমতায় বাংলাদেশের অগ্রগতি দুনিয়াজুড়ে  প্রশংসিত। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৭ সালের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭। আর এশিয়া মহাদেশে এক নম্বর।

আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আজ পর্যন্ত নারীরা স্বাধীনভাবে সমাজের সকল স্তরে পুরুষের পাশাপাশি যতটুকু অবদান/ভূমিকা রাখতে পেরেছে সেগুলোর পেছনে রয়েছে নারীদের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের সামষ্টিক ইতিহাস আর ঐতিহ্য। অবশ্য একথা বিশেষভাবে স্বীকার্য যে, নারীর এ লড়াইয়ে বন্ধুর মতো অনেক পুরুষও তার সঙ্গে সহযোদ্ধাবেশে কাজ করে গেছে, এখনও করে যাচ্ছে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে এ বিষয়ের সত্যতা ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশে নারীরা যেভাবে ঘরে-বাইরের নানামুখী পুরুষতান্ত্রিক চাপ মোকাবেলা করেও পুরুষের পাশাপাশি স্বাধীনভাবে জীবনধারণ করছেন তার জন্য তাকে সমাজ-পরিবারসহ রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানের প্রচলিত মূল্যবোধের সঙ্গে যে কী ভয়ঙ্করভাবে লড়াই চালাতে হয় তা যে কোনো স্বাধীন আর মর্যাদাবান নারী ও পুরুষের পইে বোধগম্য। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের নানা ধরনের মূল্যবোধ বা ভাবাদর্শ সর্বদাই নারী-স্বাধীনতা ও অধিকারকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে খর্ব করেছে যুগে যুগে : আজও করে চলেছে। 

আমরা কি অবজ্ঞা করতে পারব মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরপ্রতীক কাকন বিবি ও তারামন বিবির বীরত্বকে? যে দেশের পবিত্র মাটিতে প্রীতিলতার জন্ম, ইলা মিত্রের জন্ম ,বেগম রোকেয়ার জন্ম, তারামন বিবি ও কাকন বিবির জন্ম , যে দেশের স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন, সেদেশে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি, কোন অবস্থাতেই বাস্তবায়িত হতে পারে না। হেফাজত কি চায় বাংলাদেশে? নারীকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখতে? বাংলাদেশকে অন্ধকার মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিতে? বাংলাদেশকে তালেবানি তা-ব- ভূমি, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বানাতে? হেফাজতের এসব অবৈধ দাবি-দাওয়া মেনে নেয়া হলে- বেইমানি করা হবে বাংলা ও বাঙালির হাজার বছররের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে। সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে। রবীন্দ্র নাথ-নজরুল, লালন ফকির এবং হাছন রাজার অন্তরাত্মার সঙ্গে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৫০ ভাগ হচ্ছে নারী। তাদের উন্নয়ন কর্মকা-ের বাইরে রেখে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করা যায় না। ভাবা যায় না সহস্রাব্দ উন্নয়ন ল্যমাত্রা অর্জন। এ দেশে পোশাক শিল্প হচ্ছে প্রধান রফতানি খাত। এ শিল্প থেকে প্রতিবছর ২ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করে বাংলাদেশ। 

নারী আন্দোলন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এ দেশের নারীমুক্তির জন্য বেগম রোকেয়া নারী সমাজকে সচেতন হওয়ার জন্য প্রথমে শিা অর্জনের কথা বলেছেন। তিনি স¦প্ন দেখতেন মেয়েরা স্কুল-কলেজে যাবে, উচ্চশিায় শিতি হয়ে দেশের মাটিতে তারা উজ্জ্বল ভূমিকা রাখবে। লেখাপড়া শিখে পুরুষদের মতো, জজ ব্যারিস্টার, আইনজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক হবেন পাশাপাশি দেশের শাসনও করবেন। আজ প্রশাসনে, পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে মেয়েরা অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি সংসদেও নারীরা গিয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আজ নারীরাই দেশ পরিচালিত করছেন, এমনকি যে পেশায় জীবনের ঝুঁকি বেশি সাংবাদিকতায়ও সে সেক্টরেও নারীদের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। হয়েছেন সংসদের স্পীকার,ডেপুটি স্পীকার, পাইলট, সংবাদ পাঠ, রিপোর্টিংসহ ক্রাইম রিপোর্টিংও দেখা যাচ্ছে নারীদের। এসব েেত্র নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও পরিপূর্ণতা পায়নি আজও। কিন্তু ‘রাজনৈতিক মতায়নে’ নারীরা এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সে জন্য মেয়েদের রাজনৈতিক মতায়নের দাবিটি এখন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সেজন্য ‘এমপো বাস্তবায়ন ফোরাম বাংলাদেশ’-এর অন্তর্ভুক্ত ২৫টি সংগঠন ১১ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রে, বিভাগে, নগরে, জেলায়, উপজেলায় ও ইউনিয়নে সমমর্যাদায় ১০০:১০০ প্রতিনিধিত্বে নরনারীর ‘গণতান্ত্রিক মতায়ন’ সুনিশ্চিত করার জন্য লাগাতার ক্যাম্পেন করে আসছে। এছাড়াও ‘আরএস ফাউন্ডেশন’সহ বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন নারীর প্রতি বৈষম্য, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এবং নারীদের পুরুষদের সঙ্গে সমঅধিকারে কাজ করে আসছে।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন নারীর মতায়নে পরিপূর্ণভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু নারী কেন্দ্রিক দিবস পালন করলেই হবে না, নারী মতায় আসতে হলে নারীর গণতান্ত্রিক মতায়নে আসতে হবে। কেন না, গণতান্ত্রিক মতায়নের মধ্যে অবশ্যই রাজনৈতিক মতায়ন থাকছে, কিন্তু রাজনৈতিক মতায়নের মধ্যে গণতান্ত্রিক মতায়ন নাও থাকতে পারে। তার উদাহরণ অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর দিকে নজর দিলেই পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা ও অধিকার সংরণ করার প্রতিশ্রতি সংযুক্ত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে শিা, স¦াস্থ্য, বাসস্থান, সম্পর্কের মালিকানা, নীতিনির্ধারণ ও শ্রমের মূল্যায়ন, নিরাপত্তাহীনতা, নির্যাতন ও সহিংসতাসহ আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক েেত্র বিবেচনায় বাংলাদেশে এখনও নারী ও পুরুষের অধঃস্তন করে রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মতা, উন্নয়ন ও শান্তির ল্েয ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত বেজিং চতুর্থ নারী সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সব েেত্র ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণ থাকতে হবে নারীর। এক-তৃতীয়াংশ থেকে এখন নারীবাদী সংগঠনগুলো চায় ১০০ : ১০০ প্রতিনিধিত্ব নারীর গণতান্ত্রিক মতায়ন। ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী কাঠামোতে নারীর অংশগ্রহণের হার মাত্র ৫.১ ভাগ, হাইকোর্টে ৪৫ জন আইনজীবীর বিপরীতে নারী মাত্র ১জন, বিচারকের মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ৯ শতাংশ, সির্ভিল সার্ভিসে ৭.৮৮ শতাংশ নারী এবং নীতিনির্ধারণী পে তা মাত্র ০.০১২ শতাংশ।’ এখন নারী আন্দোলনের প্রতিফলন হিসেবে পর্যায়ক্রমে নারীর সমঅধিকারের দিকে এগোচ্ছে।

একটা সময় ছিল নারীরা নাগরিক হয়েও ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারত না। আন্দোলনের মাধ্যমে ভোটাধিকার বাস্তবায়ন হয়েছে। আজ নারীরাই নেতৃত্ব দিচ্ছে দেশ।৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করে থাকে গোটা বিশ্ব। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীরা আজ ক্রমে গণতান্ত্রিক মতায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে।আন্তর্জাতিক নারী দিবসে হোক ‘নারীর গণতান্ত্রিক সমঅধিকারের’ সূচনার দিন। নারীদের দেয়া হচ্ছে সমঅধিকার। এ অধিকার স্থায়ী রূপ দেয়ার জন্য নারীকে আরও আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।

বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদের ৯ জন সাধারণ সদস্য নির্বাচিত করার জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন ৯টি ওয়ার্ডে (নির্বাচনী এলাকায়) বিভক্ত। আবার সংরতি আসনে ৩ জন মহিলা সদস্য নির্বাচনের স্বার্থে প্রতি তিন ওয়ার্ডকে নিয়ে একটি একটি নির্বাচনী এলাকা গঠিত। প্রতি তিন ওয়ার্ডে একজন মহিলা সদস্য সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হলেও তাঁর প্রকৃত মতা ও মর্যাদা একেবারেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি; বরং দুর্ভোগ, কষ্ট ও নির্বাচনী ব্যয় বেড়েছে শতগুণ; এবং তাঁকে প্রায়শই ‘-নিধিরাম সর্দার’ বলে উপহাস করা হয়ে থাকে। অথচ এমপো অনুযায়ী ১০০-১০০ প্রতিনিধিত্ব অনুযায়ী প্রতি ওয়ার্ডে একজন পুরুষ মেম্বার ও একজন নারী মেম্বার নির্বাচিত করা হলে উভয় মেম্বারের মতা ও মর্যাদায় সমতা আসত; উভয় মেম্বারের দুর্ভোগ, কষ্ট ও নির্বাচনী ব্যয় কমে যেত; এবং প্রতি ওয়ার্ড কেন্দ্রীক উভয় মেম্বারের প্রতিযোগিতামূলক কর্ম তৎপরতায় গ্রামবাসী অধিকতর সেবা পেতেন। এই কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায় যে, দেশের দশ কোটি মানুষ অধ্যুষিত গ্রামীণ এলাকার ৪,৫০৫টি ইউনিয়ন পরিষদে ১০০-১০০ প্রতিনিধিত্বে নারীর গণতান্ত্রিক মতায়ন নিশ্চিত করে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে অবশ্যই ভাল হত, এবং তা হলে ১০০-১০০ প্রতিনিধিত্বে নারীর গণতান্ত্রিক মতায়নের প্রথম ও মডেল কান্টি হবার সুযোগ সৃষ্টি হত। বর্তমান জাতীয় সংসদ একটি যুগোপযোগী ইউনিয়ন আইন প্রণয়নে ও নারীর গণতান্ত্রিক মতায়নে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন বলে ভাবতে খুবই খারাপ লাগে। প্রশ্ন হচ্ছে, আর কতকাল এই খারাপ লাগাটা সইতে হবে আমাদেরকে?

লেখকঃ সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক

বুধবার, ৭ মার্চ, ২০১৮

একাত্তরের ৭ মার্চ : ঐতিহাসিক ও উজ্জ্বলতম দিন

শফিকুল ইসলাম খোকন
একাত্তরের সাত মার্চ বাঙালির জাতীয় জীবনে একটি অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক দিন। এই দিনে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখ লাখ মুক্তিকামী জনতার সামনে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। যা আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে তুলনীয়।

৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ (অলিখিত এবং স্বল্প সময়ের) বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাষণ। এটি একটি মহাকাব্যিক রাজনৈতিক ভাষণ। মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল, স্বাধীনতা আদায় ও রক্ষা এবং জনগণকে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তাসহ কূপম-ূকতা থেকে মুক্ত করার দিক-নির্দেশনা ছিল এই ভাষণে। ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রত্যাশাকেই মূর্ত করেছেন ৭ মার্চের ভাষণে। তার বজ্রকণ্ঠের আহ্বান ছড়িয়ে পড়ে বাংলার আনাচে-কানাচে আকাশে-বাতাসে। তিনি বলেন, 'আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের অধিকার চাই'। তিনি আরও বলেন, জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্ত্মান্ত্মর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারব কি পারব না। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু উদাত্তকণ্ঠে বলেন- 'আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবেলা করো...'। 'প্রত্যেক মহলস্নায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআলস্নাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ জাতিকে আহ্বান জানিয়েছিল স্বাধীনতার যুদ্ধে এগিয়ে আসতে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি সরকারবিরোধী সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার পর আপামর জনসাধারণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশের স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। অচল হয়ে পড়ে দেশ।
অতিসম্প্রতি জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ 'বিশ্বঐতিহ্য' হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভাষণ নিয়ে গবেষণা চলছে।  বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয় এই ভাষণ।

 ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হলেও এর ঐতিহাসিক পটভূমি ছিল দীর্ঘ। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্ত্মান নামে দুটি দেশ জন্ম নেয়। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল হিন্দু, পাকিস্ত্মানে প্রাধান্য ছিল মুসলমানদের। পাকিস্ত্মানের ছিল দুটি অংশ- পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্ত্মান। পূর্ব পাকিস্ত্মান ও পশ্চিম পাকিস্ত্মানের মধ্যকার দূরত্ব ছিল হাজার মাইলেরও বেশি। সংস্কৃতিগতভাবে পূর্ব পাকিস্ত্মান তথা পূর্ববাংলা পশ্চিম পাকিস্ত্মান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।

পাকিস্ত্মান রাষ্ট্রের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্ত্মানি সামন্ত্ম ও সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে। পাকিস্ত্মান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই দেশ শাসন ও অর্থনৈতিক নীতিতে উভয় অংশের মধ্যে বৈষম্য দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্ত্মান থেকে কৃষিপণ্য ও অন্যান্য সম্পদ পশ্চিম পাকিস্ত্মানে পাচার হতে থাকে। এর পর শুরম্ন হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ১৬ ডিসেম্বর অবশেষে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরম্ন করে এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই মহান স্বাধীনতা। 

আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের প্রদত্ত ভাষণ নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্ত্মর্ভুক্তির। একই সঙ্গে জনসমক্ষে এই ভাষণ বেশি বেশি বাজানো, প্রচার করা। একটি কথা চির সত্য যে, শুধু বাংলাদেশ, বাঙালি নয়, বিশ্বের মুক্তিকামী, অধিকার বঞ্চিত, স্বাধীনতাকামী জনগণের জন্য এই ভাষণ, অনুপ্রেরণা এবং দিকনির্দেশনা জোগাবেন। তাই দেশের, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আর এই ভাষণ একই সূত্রে গাথা।

রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১৮

সংবাদপত্র, স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীলতা

শফিকুল ইসলাম খোকন

পুরনো কথা বারবার নতুন করে বলতে ভালো না লাগলেও কখনো কখনো বলতে হয়, কথায় বলে “সাংবাদিকরা চতূর্থ রাষ্ট্র; সাংবাদিকরা জাতির বিবেক, জাতির আয়না, দর্পন ইত্যাদি”। আর এই সংবাদিকরাই সংবাদপত্র বা কোন গণমাধ্যমের কর্মী হিসেবে কাজ করেন। একজন সংবাদকর্মী থেকে একজন সাংবাদিক; সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের সাথে আমরা সকলেই পরিরিচত। সংবাদ পত্র হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পন। সংবাদপত্র থেকে জাতি তথা রাষ্ট্র উপকৃতই হয়। সংবাদপত্র যেমন রাষ্ট্রের গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখে, তার অবাদ বিচরণ ও স¦াধীনতাও যেমন থাকা দরকার দায়িত্বশীলতাও রয়েছে। সংবাদপত্র নৈতিকতার চর্চা করে। বিবেকের শাসন করে। সমাজ তথা রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করতে পারে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোথায় কীভাবে নৈতিকতার স্খলন হচ্ছে সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সংবাদপত্র।  

মুসলমান রাজত্বকালে ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের প্রচলন ছিল। অবশ্য তখন সংবাদপত্র মুদ্রিত হত না, সমস্ত রাজনৈতিক বিষয়ক সংবাদ হাতে লেখা হত এবং তা দেশের প্রধান প্রধান রাজকর্মচারীর নিকট প্রেরিত হত। সমস্ত œ বিভিন্ন প্রদেশের সংবাদ একত্র করে সম্রাটের কাছে যেত। এরূপ সংবাদ- সংগ্রহের জন্য আলাদা বিভাগ ছিল। কানুন এ-জং নামক প্রাচীন পারস্য গ্রন্থে লেখা আছে যে, পানিপথের প্রথম যুদ্ধে (১৫২৬ খ্রী:) বাবর শাহ শিবিরে বসে সংবাদপত্র পাঠ করছিলেন এমন সময়ে হিন্দু রাজারা এসে সন্ধির প্রস্তাব করেন। আবুল ফজল আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে লিখেছেন, সম্রাট আকবরের সময় প্রতি মাসে গভর্নমেন্ট গেজেটের মত রাজকীয় সমাচারপত্র প্রচলিত ছিল। শাজাহান আগ্রার মহরম দরবারে বলেছিলেন, "এলাহাবাদের হিন্দু রাজাদের বিদ্রোহের কথা সমাচার পত্রে পাঠ করে বিস্মিত ও বিষাদিত হলাম।" সম্রাট আওরঙ্গজেব ঔরঙ্গাবাদ নামক স্থানে জীবনলীলা সম্বরণ করেন, তাঁর পীড়ার সমাচার ও বিবরণ দিল্লির 'পয়গম-এ-হিন্দ্' নামক ফারসি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আগে এই উপমহাদেশে সংবাদপত্র প্রকাশের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে না। ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকি স্থানীয় ইংরেজদের জন্য বেঙ্গল গেজেট বা ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভার্টাইজার নামে দুই পাতার একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস, তাঁর পতœী ও ইংরেজ বিচারকদের সম্পর্কে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের দরুন এটিও দ্রুত বাজেয়াপ্ত হয়। ১৮১৮ সালের গোড়ার দিকে রাজা রামমোহন রায়ের সহায়তায় শিক ও সংস্কারক গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ করেন। ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের উদ্যোগে শ্রীরামপুর থেকে বাংলা মাসিক পত্রিকা দিগদর্শন প্রকাশিত হয়। ১৮১৮ সালের ২৩ মে বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশের এক সপ্তাহ পর সমাচার দর্পণ প্রকাশিত হয়। রাজা রামমোহন রায় বাংলা সংবাদ কৌমুদী, ইংরেজি ব্রাহ্মিনিক্যাল ম্যাগাজিন ও ফার্সিতে মিরাত-উল-আকবর প্রকাশ করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে ভারতীয় ও ইউরোপীয় সম্পাদকদের ঐক্যবদ্ধ চাপে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক বিদ্যমান সংবাদপত্র আইন শিথিল করতে বাধ্য হন। ১৮৫৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাপ্তাহিক সোমপ্রকাশ প্রকাশ করেন। ১৮৫৯ সালে ঢাকায় বাংলাযন্ত্র নামে প্রথম বাংলা মুদ্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখান থেকে ১৮৬১ সালে ঢাকা প্রকাশ প্রকাশিত হয়। এ বছরেই দি জন বুল ইন দি ইস্ট (পরবর্তী নামকরণ দি ইংলিশম্যান) ইউরোপীয়দের ও ভারতে নীলকরদের শক্তিশালী মুখপত্র হয়ে ওঠে। ১৮৬৫ সালে এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত পাইওনিয়র পূর্ণাঙ্গ সংবাদ পরিবেশনের জন্য খ্যাতি অর্জন করে। ১৮৬৮ সালে ঘোষ ভ্রাতৃগণ যশোরের ুদ্র গ্রাম ফুলুয়া-মাগুরা থেকে বাংলা সাপ্তাহিক অমৃত বাজার পত্রিকা প্রকাশ করেন (পরবর্তীকালে কলকাতায় স্থানান্তরিত)। ১৮৮১ সালে যোগেন্দ্র নাথ বসু বঙ্গবাসী প্রকাশ করেন। ১৮৭২ সালে প্রকাশিত বাংলা নীল দর্পণ নাটক ইউরোপীয় নীলচাষীদের নির্মম অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরলে সরকারি মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং ফলত সরকার ১৮৭৬ সালে নীলকরদের স্বার্থরার উদ্দেশ্যে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করে। অমৃত বাজার পত্রিকা (যশোর) সহ আরও কতিপয় স্থানীয় পত্রিকা নীলচাষীদের পাবলম্বন করে।

দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশের প্রথম উদ্যোগ নেন শ্রীরামপুরের মিশনারিরা। ১৮১৮ সালে তাদেরই উদ্যোগে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘দিগদর্শন’, ‘সমাচার দর্পণ’ প্রভৃতি পত্রিকা। একই বছর গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্য প্রকাশ করেন ‘বাঙাল গেজেট’, প্রথম বাঙালির মালিকানাধীন কাগজ। দ্বিতীয় বাঙালির কাগজটি ছিল রাজা রামমোহন রায়েরÑ ‘সংবাদ কৌমুদী’। রামমোহন রায় ফারসি ভাষায় সাপ্তাহিক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, নাম ‘মিরাৎ উল আকবর’। 

১৯৬৯ সালে প্রথম বাংলায়, পরে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় অমৃতবাজার পত্রিকা। জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রের ভূমিকায় নেমেছিল এই পত্রিকা। পরবর্তী সময় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতারা অনেকেই স্বীয় মালিকানাধীন পত্রিকা বের করেছিলেন। গান্ধীজি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রত্যেকেই কোনো না কোনো পত্রিকার সম্পাদক বা পরিচালক ছিলেন। পরবর্তী সময় দেখা যায় ব্রিটিশ শাসকরা শুধু দমননীতি দ্বারাই সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেনি, তারা একই সঙ্গে সংবাদপত্রের মালিক ও সাংবাদিকদের কিনে নেওয়ার চেষ্টাও চালিয়েছিল। ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদে শরৎচন্দ্র বসু এক বক্তব্যে ব্রিটিশ শাসকদের এই কৌশল তথ্যপ্রমাণসহ উন্মোচিত করেন। এ প্রসঙ্গে অমৃতবাজার পত্রিকার নামটিও চলে এসেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় স¦াধীন বাংলাদেশেও মাত্র গুটি কয়েক পত্রিকা থেকে আজ অসংখ্য মাসিক, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন দৈনিক পত্রিকা ইংরেজি ও  বাংলায়। এখন সংবাদপত্র একটি শিল্প হয়ে উঠেছে। শত বছর আগ থেকে সংবাদপত্রের গুরুত্ব বহন করে আসছে। সেবা খাত থেকে এখন একটি শক্তিশালী শিল্প হিসেবে সংবাদপত্রের উত্তরণ ঘটেছে। 

একটি দাবিদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে কিনা এ পশ্নে সকলের মনে বাসা বেঁধে আছে। সংবাদপত্র একটি পণ্য। তা প্রকাশ বা পরিচালনা করতে পুঁজির প্রয়োজন। এতে যেমন লাভ আছে, তেমনি লোকসানের ঘানিও টানতে হয়। সংবাদপত্রকে ভালো লাগলে মানুষ তা টাকা দিয়ে কেনে। ভালো না লাগলে কিনেনা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে বাংলাদেশের মানুষ দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করার আগেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। দেশের অগ্রযাত্রার জন্য সংবাদপত্র যেমন প্রয়োজন তেমনি সংবাদ মাধ্যমের স¦াধীনতাও প্রয়োজন। এর সঙ্গে সাংবাদিকের স্বাধীনতাও জরুরি। একজন স্বাধীনচেতা সাংবাদিক, যিনি কোনো পভুক্ত নন; তার জন্য প্রয়োজন ও রকম একটি সংবাদপত্র, সেখানে পেশাদারিত্ব চলবে। মালিকের হস্তপে থাকবেনা। আজকাল সংবাদপত্রের মালিকরাই সম্পাদক হচ্ছেন। সারা জীবন পেশায় কাটিয়ে দিয়ে তিনি একজন পুঁজির মালিকের অধীনস্থ হয়ে গেলেন। কিন্তু তাতে কী স্বাধীন সাংবাদিকতা হবে? এভাবেই স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে আসছে। 

সংবাদপত্রকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে অনেকই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা কখনই অর্থবহ হয় না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের মানবাধিকারেরই অংশবিশেষ। স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ, মানবাধিকার উন্নয়ন ও নাগরিক অধিকার সংরণে সাংবাদিক এবং সংবাদপত্রের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। একটি দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব হলে গণতন্ত্র বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। আমেরিকার নির্বাচনে দুবার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেফারসন একটি সুন্দরন কথা  বলেছিলেন, তাকে যদি সংবাদপত্রহীন সরকার এবং সরকারবিহীন সংবাদপত্র বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে তিনি সরকারবিহীন সংবাদপত্রের জগৎই বেছে নেবেন। শুধু তাই নয়, সংবাদপত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণে সংবাদপত্রের কঠোর সমালোচনাও হজম করতে পেরেছিলেন জেফারসন। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসর গ্রহণ করার পরও তিনি সংবাদপত্রের প্রতি শ্রদ্ধা হারাননি। জেফারসন আবারও বলেন, ‘সংবাদপত্র যেখানে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে এবং জনসাধারণ যেখানে পড়তে জানে সেখানে সবকিছুই নিরাপদ’। 

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ ধারায় সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, চিন্তা এবং বিবেকের স্বাধীনতা দান করা হইল। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপে-ে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।

সংবিধানের ২ উপধারাটিকে বিশ্লেষনের দিকে দেখা যায়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও এখানেও কিছু শর্ত মানতে হবে। সেগুলো হলো- এমন কিছু সংবাদ মাধ্যমে আসতে পারবে না; যার জন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। এমন কিছু প্রকাশ করা যাবে না; যার জন্য বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে। জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়- এমন তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। অশালীন এবং অনৈতিক কিছু সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না, সবসময় আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং এমন কিছু প্রকাশ করা যাবে না, যার জন্য কেউ অপরাধ করার জন্য প্ররোচিত হতে পারে। এসব শর্ত মেনে নিয়েই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়ে থাকে। এসব শর্তের লঙ্ঘন হলে আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ সংবিধানের এ ধারাটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পেছনে গভীর তাৎপর্য বহন করে। কারণ বাংলাদেশে এখন যতটুকু স্বাধীনতা বিদ্যমান, তার প্রায় পুরোটাই সম্ভব হয়েছে সংবিধানে এ ধারাটি যোগ করে। সংবিধানের মৌলিক অধিকারের েেত্র যেমন মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে; তেমনি গোপনীয়তার অধিকারের কথাও বলা হয়েছে। মত প্রকাশ করতে গিয়ে এমন কিছু করা উচিত নয়; যার জন্য একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা ব্যাহত হয়। জানার অধিকার এবং গোপনীয়তার অধিকারের মধ্যে সবসময় একটি ভারসাম্য রেখে চলতে হয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, যেখানে দেশের ও দেশের মানুষের স্বাধীনতা নেই, সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবি কোনো অর্থ বহন করে কি-না? যে দেশে মানুষের স্বাধীনতা নেই, গণতন্ত্র নেই, সে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে কী করে? আর থাকলেই বা কতটুকু থাকবে? সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলে কেউ অন্যায়-অবিচারের প্রতিকার চাইতে পারে, তার আশা-আকাঙ্খা-স্বপ্নের কথা প্রকাশ করতে পারে, স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করতে পারে এবং স্বাধীনতার জন্য যারা সংগ্রাম করছেন, তাদের কর্মকাণ্ডের বিবরণ প্রকাশ করে জনমত গঠন করতে পারে। ফলে স্বাধীনতা অর্জনের পথটা সহজ হয়। যে স্বাধীন দেশে সংবাদমাধ্যম স্বাধীন নয়, সে দেশের মানুষ স্বাধীন নয়। পৃথিবীর বহু স্বাধীন দেশের মানুষ অপরাধীন। তারা শুধু দেখেই যাবে কোন প্রতিবাদ করতে পারবে না। তারা তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে না। কর্তৃত্ববাদী সরকার সংবাদপত্রকে স্বাধীনতা দিতে নারাজ। যদিও বহু কর্তৃত্ববাদী সরকার জনগণের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ও প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু মানুষ শুধু প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার প্রাণী নয়। অধিকার বঞ্চিত, মানবাধিকার লঙ্ঘিত মানুষ এবং কর্তৃত্ববাদি, স¦ার্থবাদি দুর্নীতি অনিয়মের সরকারের বিরুদ্ধে একমাত্র কথা বলার জায়গা হচ্ছে সংবাদমাধ্যম। মানুষের স্বপ্নগুলোকে তুলে ধরার অর্থাৎ প্রকাশ করার অন্যতম প্রধান আধার বা পাত্র হল সংবাদপত্র। আধুনিক সংবাদপত্র শুধু সংবাদ প্রকাশের পত্র নয়। রাষ্ট্রের বাস্তবতা এবং জনগণের স্বপ্ন এই দুটি বিষয়ই তুলে ধরার কঠিন দায়িত্ব বর্তায় সংবাদপত্রের ওপর। আস্তে আস্তে সংবাদপত্রের স¦াধীনতাও কমে আসছে। সংবাদ মাধ্যমের ওপর হামলা গোটা বিশ্ব জুড়েই নিত্যনৈমত্যিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্টুগুলোতে দিন দিন এ অবস্থা অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। গণতান্ত্রিক দাবিদার রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক দল তথা সরকার পিছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের স¦াধীনতা। গত বছরের তুলনায় ভারত আরও তিন ধাপ পিছিয়ে ১৩৬ন¤¦রে।  আমেরিকা ব্রিটেনও ক্রমশ হারাচ্ছে গণামধ্যমের স¦াধীনতা। তারাও দুই ধাপ পিছিয়েছে তালিকা থেকে। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বলেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছাড়া সমাজে ভাল কিছু আশা করা যায় না সমাজের সবেেত্র অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য সংবাদপত্রের ভূমিকা পালন এখন অনিবার্য। সংবাদপত্রের শক্তিকে ব্যক্তিগত-রাজনৈতিক এবং কায়েমি স্বার্থে ব্যবহারের যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হচ্ছে তাতে এ শিল্পের অগ্রযাত্রা শঙ্কামুক্ত ভাবার উপায় নেই। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই প্রত্যাশিত। কিন্তু দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টিতে সংবাদপত্রের ভূমিকা এই শিল্পের জন্য লজ্জাকর এবং অপমানজনক।

আগেই বলেছি সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম একটি রাষ্ট্রের পুরুত্ববহণ করে। সংবাদপত্র নৈতিকতার চর্চা করে। বিবেকের শাসন করে। সমাজ তথা রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করতে পারে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোথায় কীভাবে নৈতিকতার স্খলন হচ্ছে সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সংবাদপত্র। সংবাদপত্রের দায়িত্বও রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সপ্তাহে একদিন বা দুদিন ছুটি থাকলেও একজন সংবাদকর্মী বা সংবাদপত্রের কোন ছুটি থাকে না। বছরে মাত্র কয়েকদিন ছুটি থাকে। একজন সংবাদকর্মী বা সাংবাদিকের যেমন দায়িত্ব অনেক, তেমনি একটি সংবাদপত্রের দায়িত্ব তার চেয়ে অনেকগুন বেশি। আগামী দিন কোন সংবাদটি যাবে, কোনটি যাবেনা, কতকলাম কত ইঞ্চিতে যাবে, কোন পাতায় যাবে ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় সংবাদপত্রের কর্ণধারদের। সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন সব সাংবাদিকের নৈতিক দায়িত্ব। স্বাধীন সাংবাদিকতার পাশাপাশি দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা বাঞ্ছনীয়। যদি একটি সংবাদপত্রের মুল ল হয় জাতির কাছে তথ্য সরবরাহ করা, তাহলে শুধু দায়িত্বশীলতাই নয়, দায়বদ্ধতাও থাকে। সংবাদপত্রের দায় থাকে কোনো তথ্য জানার অধিকার থেকে পাঠককে বঞ্চিত না হয়। আর শব্দে বানানের দিকে খেয়ালের কথা বলার অপো রাখে না। তবে তথ্য জানার অধিকার এবং গোপনীয়তার অধিকারের মধ্যে সবসময় একটি ভারসাম্য রেখে চলতে হয়। এর অন্যথা হলে সংবাদপত্র আর সংবাদপত্র হিসেবে বিকশিত হতে পারে না। তা হয়ে পড়ে নিছক সংবাদ বাহক। সমাজের দর্পণ যদি সমাজ পরিবর্তন না করে কলুষই করল, তবে তার দায়বদ্ধতার বিষয়টি নিছক বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। সমাজবিচ্ছিন্ন সংবাদপত্র তখন আর কোনো বাস্তব সামাজিক উপাদানকে ধারণ করতে পারে না। সংবাদপত্র তখন ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তখন দেশ ও রাজনীতির স্বার্থে গণমাধ্যমের ভূমিকা পালন নিয়ে বিতর্ক থেকে যায়। সংবাদপত্র যত বেশি নিরপে হবে এবং সাংবাদিকরা যত বেশি নির্ভীক ও সৎ হবেন দেশ ও জাতির জন্য তত বেশি মঙ্গলজনক হবে। 

সর্বপরি, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সঠিক পথে চালাতে হলে শুধু যে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপরে দায়িত্ব তা নয়, এখানে সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। এ কারণে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব যেমন পাঠক, সচেতনসহ আপমর জনসাধারণ তেমনি রাষ্ট্রীয় কর্তৃপরে। সাংবাদিকরা কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা না করলে পৃথিবীর অবস্থা আরো খারাপ হতো। এেেত্র তরুণ ও উদীয়মান সাংবাদিকদের মেধা, বিদ্যা-বুদ্ধি সততা এবং যোগ্যতার মাধ্যমে দেশ সেবায় দতার পরিচয় রাখতে হবে। সরকারকেও সংবাদপত্র তথা এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য অবহেলা আর দায়সারা নয়, নিজের দায়বদ্ধতা থেকে দায়িত্ব নিয়ে শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে। রেডিও, টিভি আর অনলাইন যতই থাকুকনা কেন গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্রের গুরুত্বই প্রধান।

লেখকঃ সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক
msi.khokonp@gmail.com
(২০১৭ সালের ২৫ মে দৈনিক প্রতিদিন সংবাদ পত্রিকার ৫ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর বিশেষ ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত)

শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮

৯ ফাল্গুন কেন নয়?


শফিকুল ইসলাম খোকন
গ্রাম্য ভাষায় একটি কথা আছে, “আগে ঘর ঠিক করো? পরে বাহির” অর্থাৎ আগে নিজের ঘর সামলাতে না পারলে, বাহির (সমাজ)সামলানো সম্ভব নয়; এ কথাটির সাথে আমরা সবাই একমত পোষন করতে পারি। যে জাতি  মায়ের ভাষার অধিকার রায় রক্ত দিয়েছে, তারা কোনো কিছুতেই হার মানবে না, মানার কথাও নয়। আর বাংলা ভাষা জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা? এটিতো আনন্দের কথা; কিন্তু আমাদের ঘরতো এখনো ঠিক হয়নি। ৫২ এর পরে এতো বছর পেরুলেও এখনো আমরা মায়ের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা আনতে পারিনি। আমরা বাঙ্গালী, আমরা হাড়তে শিখিনি; কারণ আমরা মাছে-ভাতে বাঙ্গালী, আমরা পিছনের সব কাজেই সফল হয়েছি। ৫২র ভাষা, ৬৯ অভ্যূত্থান, ৭১ এর স¦াধীনতা। তারই ফলশ্রতিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বা শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে গোটা বিশ্বে। তারপরেও আমাদের দেশে মায়ের ভাষাকে মুল্যায়ন করছি না।

১৯৪৭ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র ও অধ্যাপকের উদ্যোগে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এ তমদ্দুন মজলিশ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলাÑ না উর্দু?’ এ নামে একটি পুস্তিকা ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশ করে। এ পুস্তিকাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং তমদ্দুন মজলিশের প্রধান কর্মকর্তা আবুল কাসেম কর্তৃক লিখিত ভাষাবিষয়ক একটি প্রস্তাব সংযোজিত করা হয়। প্রস্তাবটিতে বাংলা ভাষা চালু করার দাবি জানানো হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক নেতৃস্থানীয় ছাত্র ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তারা নতুন ছাত্র সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ল্য, নীতি ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে একটি সার্কুলার প্রচার করেন বাংলায়। বাংলাভাষার জন্য আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এবং তা রক্তয়ী আন্দোলনে রূপলাভ করে। আন্দোলন সফল হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে বাংলা ভাষা। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমী, বাংলা উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শুরু হয় জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম। অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বাংলায় প্রণীত হয় সংবিধান। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের বিধানাবলী পূর্ণরূপে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ‘বাংলাভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ (১৯৮৭ সালের ২ নং আইন) প্রণীত হয়। 

বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি এই দিনে বাঙালির আত্মপরিচয় ও স্বকীয়তাবোধের জাগ্রত চেতনা থেকে উৎসারিত একটি দিন। এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার সম্মান রার তাগিদে বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন বাংলার দামাল তরুণরা। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে তাঁরা ঘাতকের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম-না-জানা অনেক শহীদ বুকের রক্তে রঞ্জিত করেছিলেন ঢাকার রাজপথ। তাঁরা বিদেশি শাসকদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলা ও বাঙালি এক অবিচ্ছিন্ন সত্তা। এই শক্তিকে অস্বীকার করার শক্তি কারো নেই। অমর সেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বাঙালিরা এ দিনে ছুটে যায় শহীদ মিনারে। পুষ্পে পুষ্পে ভরে যায় শহীদ মিনার। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাখো মানুষের ঢল নামে। শহীদ মিনার রূপ নেয় স্মৃতির মিনারে। আজ সেই মহান শহীদ দিবস, শুধু আমরা নই, সারা বিশ্বই পালন করবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। স্মরণ করবে, শ্রদ্ধা জানাবে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি। আমরা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করি ভাষা আন্দোলনের জানা-অজানা সব শহীদকে।

জাতিসংঘে প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় ভাষণ দেওয়ার পর অনেকেই সেখানে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। এখন চেষ্টা চলছে বাংলাকে জাতিসংঘের সরকারি ভাষায় অন্তর্ভূক্ত করানোর। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। এক সপ্তাহ পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৩০তম অধিবেশনে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্বসভায় দেওয়া বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণ ছিল বাংলায়। এই প্রথম বিশ্ব সংস্থার কোনো আনুষ্ঠানিক সভায় বাংলা ভাষা ব্যবহূতর পর বাঙালিদের মনে প্রবল উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশ-ভারত মিলিয়ে বিশ্বের ২৫ কোটিরও বেশি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। তাহলে বাংলা জাতিসংঘের সরকারি ভাষা কেন হবে না? ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করলে এ নিয়ে বাংলা ভাষাভাষীদের মনে নতুন উত্সাহের সঞ্চার হয়। দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর শেখ হাসিনা যতবার নিউইয়র্কে গেছেন, বাংলাকে জাতিসংঘের ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি করেছেন। এ নিয়ে তিনি নিউইয়র্কে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন জাতিসংঘ মহাসচিব ও অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করেছেন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের আইন পরিষদে বাংলাকে জাতিসংঘের সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দাবি করে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। যত আবেগবাহী বা চেষ্টা করা হোক না কেন, এই প্রস্তাবের বাস্তবায়ন করা কষ্টসাধ্য। বাংলা অথবা অন্য যেকোনো ভাষা জাতিসংঘের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে তা নিয়ে সাধারণ পরিষদের অধিকাংশ সদস্যের সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত হতে হবে। 

দেখতে পাচ্ছি আমরা বাংলা ভাষাকে পিছনে ফেলে রেখে ইংরেজি ভাষা চর্চা করছি। একবিংশ শতাব্দির জিডিটাল যুগে যেখানে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার সরকারের চেষ্টা চলছে সেখানে আমরা নিজেরাই বাংলার প্রতি শ্রদ্ধা রাখছি না। রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রা করি। সেই ইতিহাস আমাদের জন্য গৌরবের। শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠাই নয়, একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের ভাবনা থেকেও ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের জন্য গৌরবের হয়ে থাকবে। তবে কষ্ট হয় তখনই যখন এই ভাষার ব্যবহার সঠিকভাবে হয় না। ভাবতে অবাগ লাগে। ১৯১৮ সালে এক বক্তৃতায় জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন-‘আমরা বঙ্গদেশবাসী। আমাদের কথাবার্তার, ভয়-ভালোবাসার, চিন্তা-কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।’ কিন্তু সেই মাতৃভাষাকে আমরা এখনো ভালোবাসতে  শিখিনি। আজকের আমরা কী দেখছি- রাস্তা-ঘাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসায় সব েেত্র বাংলার বিপরীতে ইংরেজি ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ ‘বাংলাভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ এর ‘৩। (১) এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল েেত্র নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।’ তবে কিছুটা স¦স্তি ফিরে এসেছে সাইনবোর্ড বাংলা না লেখায় জরিমানা করতে দেখে। 

পৃথিবীতে মাতৃভাষার সম্মান রার জন্য আত্মাহুতি দেওয়ার ঘটনা বিরল। আমরা সেই বিরল দৃষ্টান্তের অধিকারী। এ জন্য জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত। সেই গর্ব, সেই অহংকার নিয়ে বাংলা ও বাঙালির ভাষিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও কৃষ্টি এগিয়ে নেওয়ার সার্বণিক চেষ্টা আমাদের করে যেতেই হবে। আর তার মাধ্যমেই ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। তবে সেই প্রশ্নের আজও কেউ খন্ডন করেনি বা করার চেষ্টাও করেনি। প্রশ্নটি হচ্ছে, ২১ ফেরুয়ারি কেন? ৮ ফাল্গুন কেন নয়? আমরা কেন ২১ ফেব্রুয়ারিকে ভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছি সেই ১৯৫২ সাল থেকে। তখন বঙ্গাব্দ ছিল ১৩৫৮-এর ৮ ফাল্গুন। আমার জিজ্ঞাসা আমরা কেন ১৩৫৮-এর বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন পালন করতে পারছি না। বাধাটা কোথায়? বলা হয় মাতৃভাষা দিবস। ফেব্রুয়ারি মাসটা কি মাতৃভাষা শব্দের সাথে যুক্ত নয়। মাতৃভাষা দিবস যদি বলা হয় তবে ফাল্গুন মাস স্বাভাবিকভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়। এখানে কোন অন্তরায় সৃষ্টি করে না। যেটা ফেব্রুয়ারি অবশ্যই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। হিসেব কষলে পাওয়া যায়, পাকিস্তান আমলে আমরা ১৯টি বছর একুশকে পেয়েছি এবং একুশ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত ছিল। পাকিস্তান থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। স¦াধীনতার পর থেকে  এখন পর্যন্ত সেইদিনই পালন করছে বাংলাদেশ। এখন তো পাকিস্তানি ভিনভাষীরা শাসন করছে না, তবে কেন ৮ই ফাল্গুন স্বীকৃতি পেল না? সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যথার্থই বলেছেন- আদালতে বাংলা ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা ইংরেজি আইন।

এরপরও কিন্তু বাংলাদেশের দপ্তর-আদালতে বাংলা ভাষা চালুর েেত্র কোন প্রকার বাঁধা থাকার কথা নয়। বাস্তব সত্য যে, বাংলাদেশের দপ্তর (অফিস)-আদালতে বাংলা ভাষা পরিপূর্ণভাবে আজও চালু হয়নি। এমনকি উচ্চ আদালতে রায় এবং আদেশ লিপিবদ্ধ হয় ইংরেজীতে। চিকিৎসকরা রোগিদের ব্যবস্থাপত্র দেন ইংরেজিতে, তাও বোঝা বড় দায়। যদিও উচ্চাদালতের একটি আদেশে বড় অরে লিখতে বলেছেন ব্যবস্থাপত্র। তবে আশাবাদি আগামীতে উচ্চাদালত ইংরেজিতে বড় অর নয়, বাংলাতেই ব্যবস্থাপত্র লেখার আদেশ দিবেন। সর্ব েেত্র এখন ইংরেজীকে প্রাধান্য দেয়া হয় বেশি আর বাংলাকে রাখা হয় ইংরেজির পাশাপাশি। অথচ বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাকে রাখার কথা। দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাষা প্রতিযোগিতায় সেখানেও বাংলাকে প্রাধান্য না দিয়ে ইংরেজিকে প্রাধান্য বা মুল্যায়ন করা হয়ে থাকে। ১৯৮৭ সালের ২নং আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে এ পর্যন্ত কোন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ীকে শাস্তি দেয়া হয়নি। যদিও উক্ত আইন অহরহ লঙ্ঘিত হচ্ছে। আসলে কাগজে কলমে ভাষা আন্দোলনের স¦াধীন হলেও সত্যিকারের ভাষা আজও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের পিছনের দিকে ফিরে দেখা উচিত- আইন করে কিন্তু বাংলা ভাষা কার্যকর হয়নি; আন্দোলনের মাধ্যমে হয়েছে। ফের্রুয়ারি মাস আসলেই ভাষার কথা মনে পরে যায়, মনে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার। কিন্তু বাস্তবে সেই শহীদদের মুল্যয়নতো করছি না বরং তাদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্যকেও আমরা ধরে রাখতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন- বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করতে সরকার চেষ্টা করছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি- আগে নিজের ঘর ঠিক না করতে পারলে অন্যের ঘর ঠিক করা সম্ভব নয়। হ্যাঁ আমাদের মায়ের ভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করবেন সেটি অবশ্যই আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়। কিন্তুু আমরা এখনো মায়ের ভাষাকে প্রাধান্য দিতে পারেনি, করতে পারিনি ভাষা শহীদের মুল্যায়ন। আমাদের দেশের প্রত্যেক সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ সকল প্রতিষ্ঠানে আগে মায়ের ভাষাকে বাধ্যতামুলক করা উচিত।

এতো কিছুর পরেও বারবার প্রশ্ন রয়ে যায়, তাহলে বাংলা ভাষা সর্বেেত্র বাস্তবায়নের দায়িত্ব কার উপরে? কেই বা এর দায়িত্ব নিবে? উচ্চাদালতের রায়কেও আমরা বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়েছি। আমি মনে করছি- এর দায়িত্ব শুধু সরকারের একার নয়, এর দায়িত্ব সরকারি কর্মকর্তা, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিসহ আপমর জনসাধারণের। এ েেত্র সরকারের পাশাপাশি বড় ভুমিকা রাখতে পারে বাংলা একাডেমি। তাহলে সরকার বা বাংলা একাডেমী কি করছে? এই প্রতিষ্ঠানটিই কিন্তু এই প্রধান প্রধান একাধিক কাজগুলোর দায়িত্ব ঠিক ঠিকভাবে সমাপ্ত করতে পারত। যেমন প্রধান বিষয়ের মধ্যে বইমেলা ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু না করে ১ ফাল্গুন থেকে শুরু করতে পারত। এতে এমন কিছুর অন্তরায় তো দেখছি না। একটি ঘোষণা দিলেই সবকিছুর সমাধান হতো-বইমেলার উৎসুক দর্শক-পাঠকরা সেই অনুসারেই আসা-যাওয়া করত। অসুবিধা তো হবার নয়। হয়তো খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করাতে বলত, ভাই যেটা চলে আসছে। হ্যাঁ, আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি এটি সত্য। আবার এটিও সত্য যে, বাংলা ভাষা এখন শুধু জাতিসঙ্গেই নয় আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা ভাষা স¦ীকৃতি পেয়েছে এবং এ দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেই গোটা বিশ্বে পালন করছে। তাহলে এমন খোড়া যুক্তির তেমন কাজে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। আমরা বাংলাদেশী, আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, বাংলা আমার মায়ের ভাষা, তাহলে কেন আমরা ২১ ফেরুয়ারি ব্যবহার করছি? ১ ফাল্গুন যদি ঢাকঢোল বাজিয়ে বসন্ত উৎসব পালন করতে পারি, তাহলে কেন ৯ ফাল্গুন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করতে পারবো না। এখানে বাঁধাটা  কোথায়। আসলে বাধাটা হচ্ছে মনে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। এখানে শেখ হাসিনার সরকারই এর বড় ভুমিকা রাখতে পারবে। 

পরিশেষে বলতে চাই- এখনো রাষ্ট্র ভাষা বাংলা সঠিকভাবে রুপান্তরিত হয়নি। ভাষা আন্দোলন বলতে ৫২ এর ভাষা আন্দোলনকেই বুঝায়, কিন্তু প্রকৃত পে মাতৃভাষা নিয়ে ুদ্র ুদ্র আন্দোলন বা সংগ্রাম দেশে বিভাগের অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। তেমনি শুধু ৫২এর আন্দোলনই শেষ নয় এখনো বাংলা ভাষার আন্দোলন শেষ হয়নি। আসুন আমরা সবাই বাংলা ভাষাকে মায়ের মত করে বুকে টেনে নেই। তা নাহলে ভাষা শহীদদের আত্মা হয়তো শান্তি পাবে না। আমাদের দাবি- জাতিসংঘের ৬টি দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, মান্দারিন, রুশ ও আরবির সাথে এবার বাংলাকে ৭ম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হোক।

লেখক [সাংবাদিক কলামিষ্ট ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক]
msi.khokonp@gmail.com

শুক্রবার, ২ মার্চ, ২০১৮

লাল-সবুজের পতাকার কেন অবমূল্যায়ন?

শফিকুল ইসলাম খোকন 

যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়- বাংলাদেশকে ভালোবাস? উত্তরে আসবে 'হ্যাঁ' যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়- জাতীয় পতাকাকে ভালোবাস? উত্তরে আসবে 'হ্যাঁ'। ঠিক তেমনি যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়- জাতীয় পতাকার আকার, ব্যবহারের নিয়ম জানো? উত্তরে...। একজন স্বাধীনচেতা মানুষ, স্বাধীন বাংলাদেশের দাবিদার নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব রয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাস-ঐতিহ্য জানা, সংরক্ষণ করা তেমনি রয়েছে জাতীয় পতাকাকে সম্মান এবং ব্যবহারের নিয়ম জানা। 

৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার যে স্বাধীনতা সূর্য অস্ত্ম গিয়েছিল, তা একাত্তরের মার্চে পুনরায় উদিত হয়। বাঙালি পরাধীনতার শৃঙ্খল চূর্ণবিচূর্ণ করে দেশকে শত্রম্নমুক্ত করার জন্য স্বাধীনতার লড়াইয়ে শরিক হয়। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেদিন সমগ্র জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। এ ধরনের ঐক্য আমাদের জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা এনে দেয় নতুন চেতনা এবং মূল্যবোধ। যে জাতি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে নিজের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করে, সে জাতি কোনো দিন পিছিয়ে থাকতে পারে না। নতুন প্রজন্মের জন্য অপেক্ষা করছে নতুন দিন, এক সুখী-সমৃদ্ধ-উন্নত বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে 'আর আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম' সুতরাং জাতির অসহযোগ আন্দোলনকে সশস্ত্র আন্দোলনের দিকে নিয়ে যায়। জাতির এই লৌহকঠিন ঐক্যবদ্ধ প্রস্তুতির কারণেই তখনকার সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করেন বাঙালি বীর সন্ত্মানরা, এমনকি সুদূর পাকিস্ত্মান থেকেও মৃত্যুকে উপেক্ষা করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জনগণের অন্ত্মরাত্মার প্রস্তুতি অনুভব করেই পাকিস্ত্মান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করার নৈতিক শক্তি তারা পেয়েছেন বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণেই জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিকামী মানুষ পাকিস্ত্মানিদের বিরম্নদ্ধে। শুরম্ন হয় স্বাধীনতা, ৯ মাস যুদ্ধ শেষে লাল-সবুজের স্বাধীন রাষ্ট্র পায় বাংলাদেশ। 

আমি একজন নতুন প্রজন্মের নাগরিক। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, মুক্তিযুদ্ধ করিওনি। তবে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে আমাকে কাঁদায়। সব সময় আমাকে ভাবিয়ে তোলে। যে জাতি জীবনের বিনিময় দেশ স্বাধীন করেছে, সে জাতি কখনোই হেরে যাওয়ার নয়; হারতে শেখেনি, হারতে পারেও না। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমি শুনেছি। যতবারই শুনি ততবারই দেহের ভেতরে মন নামক প্রাণটি ভাবিয়ে তোলে, বিবেক তাড়িত করে। প্রশ্ন করে- 'তুমি মুক্তিযুদ্ধ দেখনি, মুক্তিযুদ্ধ করনি, কিন্তু যা দিয়ে গেছি, তা কি তুমি সংরক্ষণ করছ? সম্মান দিচ্ছ? না কি সব পেয়ে ভুলে গেছ।' বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আর বাঙালি জাতির জীবনে সোনালি দিন হচ্ছে ১৯৭১ সালের মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলো। নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম আর আন্দোলনের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে একাত্তরের গৌরবময় দিনগুলো আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা কি সেই স্বাধীনতা নামক শব্দটি ভুলে যেতে বসেছি? আমরা সেই লাল-সবুজের পতাকাকে সংরক্ষণ করছি, ইতিহাস-ঐতিহ্য কি বুকে আগলে রাখছি। আমি একজন নতুন প্রজন্মের নাগরিক হিসেবে মনে করি- 'না পারিনি, পারছিও না। প্রশ্ন হচ্ছে দায়িত্ব কার? কে সংরক্ষণ করবে। নতুন প্রজন্মকে জানান দেয়ার দায়িত্ব বা কাদের? আর সেই দায়িত্ববোধ থেকে কতটুকুই দায়িত্ব পালন করছি, নতুন প্রজন্মের মাঝে কতটুকু স্বাধীনতা-বিজয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তুলে ধরছি?' 
একটি জাতীয় পতাকা একটি জাতি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের একটি স্বীকৃতি। জাতীয় পতাকা হলো জাতির আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা এবং শহীদদের সম্মানের প্রতীক। জাতীয় পতাকা বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে, বিশ্বের কাছে দেশকে পরিচিত করে। আমরা কি দেখছি, সেই জাতীয় পতাকাকে আমরা মূল্যায়নের চেয়ে অবমূল্যায়নই বেশি করছি। তার কারণ হতে পারে দু'রকমের একটি হলো পাতাকার নিয়ম-কানুন না জেনে বা যেনেও না জানার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া। আমরা দেখছি, কখনো কখনো আবেগের বসে জাতীয় পতাকা ঠেলাগাড়ির রডের সঙ্গে বেঁধে রাখা, ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিয়ম না মেনে পাতাকা টানানো, পাতার সঙ্গে নির্ধারিত বাঁশ বা অন্য কিছু ব্যবহার না করে অবেহলার মতো কোনো রকম ভাঙা বাঁশ, লাঠি, ভাঙা পস্নাস্টিকের পাইপ দিয়ে পতাকা টানানো হচ্ছে। এ বিষয় কঠোর হস্ত্মক্ষেপ না থাকা এবং আইন জানার কারণেই এ রকমটা হচ্ছে। 

তবে আইনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। জাতীয় পতাকা বিধিমালা-১৯৭২ (সংশোধিত ২০১০)-এ বলা আছে, জাতীয় পতাকা গাঢ় সবুজ রঙের হবে এবং ১০:৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তক্ষেত্রাকার সবুজ রঙের মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত থাকবে। লাল বৃত্তটি পতাকার দৈর্ঘ্যের এক-পঞ্চমাংশ ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট হবে। এবং লালবৃত্তটি ঠিক কোন অংশে থাকবে, সেটিও উলেস্নখ করা আছে। আইনে পতাকার রঙ, ছোট গাড়ি, মাঝারি বা বড় গাড়িতে এর আয়তন সবই লেখার পাশাপাশি পতাকা উত্তোলনের বিষয়েও বলা আছে। ইচ্ছে করলেই যে কেউ গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করতে পারবেন না। বিধিমালার '৪ এর (১) নিম্নবর্ণিত দিবস এবং উপলক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারি ও বেসরকারি ভবনসমূহে এবং বিদেশে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশনের অফিস ও কনস্যুলার পোস্টসমূহে নিম্নরূপ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করিতে হইবে: (ক) মহানবীর জন্ম দিবস (ঈদে মিলাদুন্নবী); (খ) ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস; (গ) ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস; (ঘ) সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত অন্য যে কোনো দিবস। ১ (২) নিম্নবর্ণিত দিবসসমূহে 'পতাকা' অর্ধনমিত থাকিবে: (ক) ২১ ফেব্রম্নয়ারি শহীদ দিবস; (খ) ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস; এবং (গ) সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত অন্য যে কোনো দিবস।' কিন্তু বাস্ত্মবে দেখা গেছে, অনেকই জায়গায়ই অসচেতনার কারণে অনেক ব্যতিক্রম ঘটে। তবে এটি সত্য যে, জাতীয় পতাকা ব্যবহার রয়েছে সর্বোচ্চ প্রশংসনীয় পর্যায়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে মনিটরিং, নিয়ম ও বিধি মানা হচ্ছে না মানতে দেখা যাচ্ছে না। 

আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করা বা জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করলে ওই ব্যক্তিকে ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। ২০১০ সালের জুলাই মাসে এই আইন সংশোধিত হয়। এই সংশোধনীতে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত্ম শাস্ত্মি এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়। না জেনে, না বুঝে আর অতি উচ্ছ্বাসে যারা পতাকা ব্যবহারবিধি লঙ্ঘন করেন, তাদের অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে এই শাস্ত্মির বিধান যথাযথ হতে পারে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বাণিজ্যিক কোনো প্রচারণায়, বিজ্ঞাপনে জাতীয় পতাকার ব্যবহার বিধিবহির্ভূতভাবে করে থাকে, তার জন্য ১০ হাজার টাকা অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়েছে, যাকে অনেকেই অপ্রতুল মনে করছেন। আইনে এত বিধি বিধান থাকলেও বাস্ত্মবে এর রূপ দেখা যায়নি। দেখা যায়নি তেমন কোনো শাস্ত্মি দিতে। আমরা মনে করি- জাতীয় পতাকা ব্যবহারের নিয়মের বিষয় জনগণকে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য সভা-সেমিনার করা উচিত। আইনটি সবার জানা দরকার এবং পতাকা আইন অনুযায়ী ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটি মনিটরিং দরকার। ইউনিয়ন-ওয়ার্ডভিত্তিক নির্ধারিত একটি দিনে শুধু পতাকা নিয়ম-আইনসহ নানা বিষয়ে সচেতন করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে শুধু সরকার বা প্রশাসন নয় জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। তা নাহলে একদিন স্বাধীন-সার্বভৌমের ইতিহাস ঐতিহ্য ভুলে যেতে বাধ্য। 

স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্ত্মিত্বকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার, একইভাবে জাতীয় পতাকার সম্মানও অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় পতাকার মান অক্ষুণ্ন্ন রাখব স্বাধীনতার মাসে এটাই প্রত্যাশা করছি।

(শফিকুল ইসলাম খোকন সাংবাদিক, কলামিস্ট ও স্থানীয় সরকার গবেষক)
msi.khokonp@gmail.com
সূত্রঃ দৈনিক যায়যায়দিন ও প্রতিদিনের সংবাদ, প্রকাশের তারিখঃ ২ মার্চ ২০১৮

নদী মরলে দেশও মরবে

: শফিকুল ইসলাম খোকন : নদীমাতৃক দেশে নদীই আমাদের ভরসা। নদী আমাদের হৃৎপিণ্ড, নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না, প্রকৃতি বাঁচবে না, পরিবেশের সুরক্ষা ...