শফিকুল ইসলাম খোকন

মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

নদী মরলে দেশও মরবে

: শফিকুল ইসলাম খোকন :


নদীমাতৃক দেশে নদীই আমাদের ভরসা। নদী আমাদের হৃৎপিণ্ড, নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না, প্রকৃতি বাঁচবে না, পরিবেশের সুরক্ষা হবে না, এমনকি টেকসই উন্নয়নও সম্ভব নয়। নদীগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও নদী রক্ষায় আমাদের তেমন কোনো জোরালো ভূমিকা বা কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত ‘রামসার কনভেনশন ১৯৭১’ এবং ‘রিও কনভেনশন ১৯৯২’ স্বাক্ষর করায় ভূমি ও জলজ পরিবেশ রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ কনভেনশন দুটির প্রথমটি জলজ পাখির আবাস সংরক্ষণসংক্রান্ত, যা নদী ও জলাভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষার ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয়। দ্বিতীয়টি ভূমি ও জলের সব প্রজাতির উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসংক্রান্ত, যা একই লক্ষ্যে অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের টাঙ্গুয়ার হাওড় ও সুন্দরবন এলাকা ‘রামসার সাইট’ হিসাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। হাকালুকি হাওড় এবং সুন্দরবনকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ‘পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকা’ ঘোষণা করায় ওই দুই এলাকার নদী ও জলাভূমিগুলো সংরক্ষণের বেলায় সরকারি দায়বদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু এখনই আমাদের দেশের আরও অনেক জলাভূমিকে ‘রামসার সাইট’ হিসাবে এবং ‘পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকা’ হিসাবে ঘোষণা করা উচিত।

সারা দেশেই আগ্রাসী থাবায় নদীগুলো বিপর্যস্ত। যে কোনো নদীর পাড়ে চোখ মেলে তাকালেই দখলবাজির চিত্র স্পষ্ট দেখা যায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, অনেক নদ-নদীর অস্তিত্বই এখন হুমকির সম্মুখীন। অনেক নদী ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে। দখল ও দূষণের কারণে গত ৪ দশকে দেশের ৪০৫টি নদ-নদীর মধ্যে বিলুপ্ত হওয়ার পথে ১৭৫টি। বাকি ২৩০টিও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ কমে হয়েছে ৬ হাজার কিলোমিটারের মতো। কৃষি, যোগাযোগ, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মানুষের জীবনযাত্রা সবকিছুর জন্যই এটা ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। নদী-জলাশয় রক্ষার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিবেশ সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো, একেবারে শীর্ষ থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের পদাধিকারীরা নানা কথা বলে চলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আদালতের নির্দেশেও খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।

সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন নদীর পানিতে ১১ ধরনের ক্ষতিকর ধাতুর দেখা মিলেছে। গবেষণায় যেসব নদী, হ্রদ বা খালের দূষণের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ব্রহ্মপুত্র, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বংশী, ধলাই বিল, মেঘনা, সুরমা, কর্ণফুলী, হালদা, খিরু, করতোয়া, তিস্তা, রূপসা, পশুর, সাঙ্গু, কাপ্তাই লেক, মাতামুহুরী, নাফ, বাকখালি, কাসালং, চিংড়ি, ভৈরব, ময়ূর, রাজখালি খাল। আর এসব জলাধারের পানিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে জিংক, কপার, আয়রন, লেড, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, কার্বন মনোক্সাইড ও মার্কারির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, গত ৪০ বছরে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ আশপাশের অবিচ্ছিন্ন নদীগুলো চরম মাত্রার দূষণের শিকার হয়েছে। বরিশালের কীর্তনখোলা, বরগুনার খাকদোন নদীও দিন দিন মরে যাচ্ছে। নদীগুলো যে দখলই হচ্ছে তা নয়, শিল্পবর্জ্যরে ভারী ধাতু পানিতে মিশে নদীর তলদেশে মারাত্মক দূষণ তৈরি করে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে নদীর পানিতে ক্ষতিকর ধাতুর ঘনত্ব বেশি পাওয়া যায়।

সবশেষে দেশে নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে ২০১৯ সালে তালিকা প্রণয়ন শুরু করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি)। প্রায় চার বছর কাজ শেষে গত ১০ আগস্ট সংস্থাটির ওয়েবসাইটে ৯০৭টি নদ-নদীর খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন নদী গবেষকরা। এমনকি সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত নদ-নদীর তথ্যের সঙ্গেও এনআরসিসির খসড়ার তথ্য মিলছে না।

এদিকে দেশের ৪০৫টি নদ-নদী নিয়ে ২০১১ সালে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এ নিয়ে ছয় খণ্ডের বইও প্রকাশ করেছিল সংস্থাটি। ওই ৪০৫টি নদ-নদীর মধ্যে ১৩৯টিই এনআরসিসির খসড়া থেকে বাদ পড়েছে। ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ নামে ছয় খণ্ডে প্রকাশিত ওই সিরিজের সঙ্গে এনআরসিসির খসড়া তালিকার নদ-নদীর তথ্যে ব্যাপক গরমিল আছে বলে দাবি করেছে নদীবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, পাউবোর সমীক্ষার অন্তত ১৩৯টি নদীর নাম এনআরসিসির খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের আমরি, ইসদার, উমিয়াম, কর্ণঝরা, কর্ণবালজা, কাঁচামাটিয়াসহ ২৭ নদীর নাম তালিকাভুক্ত করেনি এনআরসিসি। একইভাবে রাজশাহী বিভাগের ১৬, রংপুরের ১০, ময়মনসিংহের ২৭, বরিশালের সাত, ঢাকার ৩০, চট্টগ্রামের ১২ ও খুলনা বিভাগের ১০টি নদী তালিকাভুক্ত করেনি এনআরসিসি।

থ্যে খুবই সহজেই অনুমেয় কী হচ্ছে নদী নিয়ে। আসলেই কি দেশের পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করা হচ্ছে? টেকসই উন্নয়নে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। গবেষণায় জানা যায়, ২০০৯ সালে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহৃত হয়েছে ৬৮ বিলিয়ন টন। ২০৫০ সালে ব্যবহৃত হবে ১৪০ বিলিয়ন টন, যা পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করবে। মানুষের কারণে ২০ শতাংশ চাষযোগ্য জমি, ৩০ শতাংশ বনভূমি এবং ১০ শতাংশ চারণভূমি হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশে আবাসন ও শিল্পায়নের কারণে প্রতি বছর ১ শতাংশ কৃষিজমি কমছে। জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হচ্ছে। অর্ধেকেরও বেশি নদী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকিগুলো দখলে বিপর্যস্ত। টেকসই উন্নয়নের জন্য যে অর্থনীতি আমাদের প্রয়োজন, সেই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে নদীকে তার হারানো গৌরব ও যৌবন ফিরিয়ে দিতে হবে। নদী আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। টেকসই উন্নয়ন ও নদী রক্ষায় সবাইকে নিয়েই সামনে এগোতে হবে। নদীর ব্যবহার এখন বহুমাত্রিক। মানুষ বুঝে না বুঝে নদীকে ব্যবহার করছে। নদীর কাছেই গড়ে উঠেছে বড় বড় কল-কারখানা, নদীতে এখন হাজার হাজার লঞ্চ-স্টিমার। নদীতে শত শত বাঁধ। নদী দখল, নদী দূষণসহ যখন যেভাবে প্রয়োজন, তখন সেভাবেই নদীকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিটি জেলায় নদী রক্ষা কমিটি রয়েছে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে। তাদের কাজ কী? তারা আসলে কী করে? নদী ভরাট ও অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে সবাইকে নিয়ে কাজ করছে এই কমিটি, নদী খননের প্রশাসনিক কার্যাদি সম্পাদন ও নদী রক্ষায় নানা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কাজও করছে এ কমিটি। কিন্তু শুধু জেলা প্রশাসন অথবা পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী বাঁচাতে পারবে না। ডিসিদেরও সরকারসহ উচ্চাদালত থেকে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তাদের নীরব ভূমিকা দেখা গেছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষমতাসীন দলের নেতাদেরও অন্যতম ভূমিকা রয়েছে। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি সরকারকে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলোর কাজের গতি ত্বরান্বিত করতে হবে। আবার এসব কাজের জবাবদিহি বাড়াতে হবে। দেশের নদী রক্ষা, জলাশয় ও খাস সম্পত্তি সংরক্ষণ এবং নদী দখল রোধে সরকার ও উচ্চাদালতের কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ডিসিরা তা মানছেন না। আদালতের নির্দেশনার পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব ও কার‌্যাবলি-২০১১ প্রজ্ঞাপনের ১৫ দফায় সম্পত্তি অধিগ্রহণ এবং হুকুম দখলের সুস্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে ডিসিদের ওপর।

নদী ও জলাশয়ে রয়েছে অনেক সম্পদ। কথায় বলে, পরিবেশ বাঁচলে দেশ বাঁচবে, দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচব। আমাদের অসচেতনতার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। জীবনধারণের স্থান ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নিজ উদ্যোগে, নিজের স্বার্থে নদীকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সবাই সচেতন না হলে শুধু আইন প্রয়োগে খুব বেশি সফলতা আসবে না। পরিবেশকে বিবেচনায় না রেখে একটি সুন্দর পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। পরিবেশ আর উন্নয়নের মধ্যকার সম্পর্ক পরস্পরবিরোধী নয়। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশের রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক। পরিবেশকে রক্ষা করে দেশের উন্নয়ন না করলে তা টেকসই হবে না। এজন্য শুধু সরকার বা বিভিন্ন সংস্থাকে কাজ করলে চলবে না, সমাজের প্রত্যেক মানুষকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করত হবে। পরিবেশ বাঁচিয়েই অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সম্ভব করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, মানুষ যেমন হৃৎপিণ্ড না থাকলে বাঁচে না, তেমনি নদী না থাকলে দেশও বাঁচানো সম্ভব নয়। যেভাবে নদী মরছে, আর যেভাবে নদীগুলো কাঁদছে, তাতে একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে দেশ। একটি দেশকে বাঁচাতে হলে এবং টেকসই উন্নয়ন করতে হলে নদীগুলো সংরক্ষণ করার বিকল্প নেই। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি। দেশ রক্ষা, পরিবেশ সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে মুক্তির জন্য নদী ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

শফিকুল ইসলাম খোকন : গবেষক ও লেখক

msi.khokonp@gmail.com

সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর, তারিখঃ ২৪ সেপ্টে¤¦র ২০২৩

শনিবার, ১৮ মার্চ, ২০২৩

শিশু বয়সেই বৈঠা হাতে দক্ষ তারা

: শফিকুল ইসলাম খোকন: 

 ১৩ বছরের শিশু রাকিবুল। এ বয়সে আর দশজন শিশুর মতোই তারও স্কুলে যাওয়ার কথা। কিন্তু ১০ বছর থেকেই এই দুরন্ত শিশুকে দারিদ্র্যে কষাঘাতে পড়তে হয়। ১৪ বছরের সাব্বিরের একই অবস্থা। সাব্বির আর রাকিবুল এখ
ন দক্ষ মাঝি। 

শুধু সাব্বির, রাকিবুলই নয়, তাদের মতো একই অবস্থা বরগুনার উপকূলবর্তী এলাকার অনেক শিশুর। পারিবারিক অভাব-অনটন এসব শিশুর হাত থেকে বই নামিয়ে তুলে দিয়েছে বৈঠা ও মাছ শিকারের জাল। এরকম অবস্থা দেশের আরও অসংখ্য শিশুর। এমন শিশুদের সম্পর্কে হয় অনেক সভা-সমাবেশ। কিন্তু সাব্বির-রাকিবুলদের জীবনের কোনো পরিবর্তন আসে না।  দিনে দিনে সাব্বির-

রাকিবুলের মতো দক্ষ মাঝি হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের অনেক শিশু। তাদের কেউ অভাবের তাড়নায়, কেউ পরিবারের অবহেলা ও অসচেতনতায়, আবার কেউবা সামাজিক অবয়ের কারণে। জলবাযু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলের শিশুরাও এমন ঝুঁকির পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এমনিতেই উপকূলের মানুষ দারিদ্রতার কারণে এসব কাজে ঝুঁকছে, পাশাপাশি শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়ছে শিশু।  

বিশেষ করে করোনার সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এবং পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে, পরে বিদ্যালয় খুললেও আর ফেরেনি। জলবাযু পরিবর্তনের ফলে জীবিকা পরিবর্তন হয়েছে এবং মাইগ্রেশন বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝরে পড়ার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

সুন্দরবন সংলগ্ন বলেশ্বর নদে সারি সারি নৌকা। তবে এই নৌকাগুলো দেখলে যে কেউ বুঝবেন এগুলো মাছ ধরার নৌকা। এসব নৌকায় কিছু মানুষের ঘর-বাড়িও। পরিবারের কাছ থেকে বড়দের মতো শিশুরাও বিদায় নিয়ে বলেশ্বর নদে মাছ শিকারে আসে। এ নদীতেই থাকতে হয় দিনের পর দিন ঘর বাড়ির মতো। যে বয়সে মায়ের কোলে নিরাপদে থাকার কথা জীবিকার তাগিদে নদীতেই থাকতে হয় ঝুঁকি নিয়ে। ঝড়-জলোচ্ছাস, প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার মধ্যেও এসব শিশুরা নদীতে থাকে। ঘূর্ণিঝড় আসলে সৃষ্টিকর্তার ওপরই একমাত্র ভরসা। সব সময় নদীর উত্তাল মোহনায় বেশ ঝুঁকির মধ্যেই এসব শিশুরা বেড়ে ওঠে। অবহেলার মধ্যে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দুরন্ত শৈশব কাটছে ওদের।

সরেজমিন বলেশ্বর নদ সংলগ্ন চরদুয়ানী ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে ট্রলার ও নৌকা ঘাটে নোঙর করে আছে। অনেক নৌকা-ট্রলার ঘাটে নোঙরের চেষ্টা করছে। ঠিক এমন সময় দেখা মেলে সাব্বিরকে। কচি হাতে শক্ত বৈঠা নিয়ে দক্ষ মাঝি মতো ঘাটে নৌকা আনছে। ঘাটে মাছ বিক্রি করার জন্যই এসব ট্রলার নিয়ে ঘাটে ফিরেছেন।

কথা হয় ১৩ বছরের শিশু সাব্বিরেরর সঙ্গে, চাচা আবুলের সঙ্গে ১০ দিন আগে পিরোজপুরের জিয়ানগর এলাকা থেকে পাথরঘাটা সংলগ্ন বলেশ্বর নদে মাছ শিকার করতে আসে। ১০ দিন মাছ শিকার করে মাত্র ৪ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করে। মাদরাসায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে আর পড়তে পারেনি। সেই থেকেই মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত সাব্বির।

কিভাবে পারিশ্রমিক পায় জানতে চাইলে শিশু সাব্বির বলে, এখানে দৈনিক ভিত্তিতে কোনো পারিশ্রমিক নেই। শেয়ারে ব্যবসার মতো। লাভ-লোকসান সমানে সমান। ৬ দিনের জন্য ৫ হাজার টাকার বাজার সদয় নিয়ে নদীতে মাছ ধরার জন্য বাড়ি থেকে আসি দাদার সঙ্গে। ১০ দিন থাকার পর মাত্র ৪ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেছি। কাঙ্খিত মাছ না পাওয়ায় বাড়ি না গিয়ে চরদুয়ানী ঘাটে এসে আবার বাজার সদয় করে নদীতে মাছ ধরার জন্য থাকতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত লাভের মুখ দেখিনি।

শিশু সাব্বিরের সঙ্গে কথা বলার সময়ই হঠাৎ চোখে পড়ে শিশু রাকিবুলের সঙ্গে। দাদা সেকান্দার হাওলাদার মাছ বিক্রির জন্য গেছেন চরদুয়ানী বাজারে। এদিকে ছোট নৌকায় বসে নিজে রান্না করছেন রাবিকুল। এ বয়সে রান্না তো দূরে থাক নদীতে এমন ঝুঁকির কাজ করার কথা নয়। পেটের দায়ে করতে হচ্ছে রাকিবুলের মতো অসংখ্য শিশুদের। কথা হয় রাকিবুলের সঙ্গে, গল্প বলেন দাদ্রিতা নিয়ে। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ২ মাস লেখাপড়া করেছিল রাকিবুল। মহামারি করোনার ছোবল আর পরিবারের অভাব-অনটনে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি তার।

এদিকে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকার পরিবারে অভাব-অনটন, স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া নানা কারণে দিন দিন বাড়ছে শিশু শ্রমিক ও জেলের সংখ্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলের বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত এমন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। অন্যদের সঙ্গে পেশায় টিকে থাকতে এসব শিশুরা ১২ থেকে ১৪ বছরেই হয়ে উঠছে দক্ষ জেলে ও মাঝি।  

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর পাড়ে অনেক শিশু, কিশোর-কিশোরী মাছ শিকারে ব্যস্ত। কেউ কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে কোমড় পানিতে নেমে জাল টানছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আরডিএফ) তথ্যানুযায়ী, পাথরঘাটা উপজেলায় ২১০০ শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ে। তার মধ্যে মেয়ে ৭৯৫ ও ছেলে ১৩০৫। এসব ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষামুখি করতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পাথরঘাটায় ৭০টি শিশুর শিখন কেন্দ্রের কার্যক্রম চলছে।

শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আরডিএফ) যুগ্ম পরিচালক মো. এনামুল হক বলেন, করোনা কালে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এবং পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে, পরে বিদ্যালয় খুললেও আর ব্যাক করেনি। তালতলীতে একটা জরিপ আছে, সেখানে বাল্যবিবাহ ও গার্মেন্টস এ যাওয়ার প্রবণতা বেশি।  

তিনি আরও বলেন, জলবাযু পরিবর্তনের ফলে জীবিকা পরিবর্তন হয়েছে এবং মাইগ্রেশন বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝরে পড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন চিত্র পুরো জেলায়।

এ বিষয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘জাগো নারী’র  পরিচালক ডিউক ইবনে আমিন বলেন, শিশু শ্রমকে স্থানীয়ভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে, যে সকল শিশু আর্থিক কষ্টের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং একই সঙ্গে তাদের পরিবারকে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।  

বেসরকারি সংস্থাগুলো স্কুল থেকে ঝরে পরা শিশুদের চিহ্নিত করে তাদের বিশেষ শিক্ষার মাধ্যমে আবার স্কুলমুখী করতে কাজ করতে পারে।

পাথরঘাটা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার টিএম শাহ আলম বলেন, শিশু শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ছে এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। পারিবারিক সমস্যা, আর্থিক সমস্যাসহ নানাবিধ সমস্যার কারণে ঝড়ে পড়ে, কিছু কিছু শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে মাদরাসাগামি হয়।  

তিনি আরও বলেন, ঝড়েপড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষামুখী করতে সচেতনতার বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি সকলের সমন্বয় এগিয়ে আসতে হবে। সচেতন‌ করতে আমরা মা সমাবেশ করে থাকি।

মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ, ২০২৩

২৫ নির্দেশনা পালনে যত্নবান হবেন কি ডিসিরা

শফিকুল ইসলাম খোকন
:শফিকুল ইসলাম খোকন:

একটি পরিবার যেমন কিছু নিয়ম-নীতির মধ্য দিয়ে চলে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রও সংবিধান, আইন, নীতিমালা, বিধি দিয়ে পরিচালিত হয়ে থাকে। আর ওই রাষ্ট্রের প্রধান বা সরকার প্রধানের কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও মেনে চলতে হয়। একটি রাষ্ট্রের আইন ও সরকারের সঠিক নির্দেশনা প্রয়োগ, বাস্তবায়ন করেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কিন্তু এমন নির্দেশনা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে অনেকাংশে অনিহাই দেখা গেছে। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে ‘আদালতের নির্দেশনা মানছেন না আমলারা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং প্রধানমন্ত্রীর ডিসিদের ২৫ দফা নির্দেশানায় কিছুটা আছ করা যাচ্ছে।

২৪ জানুয়ারি সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, গুজব, খাদ্যে ভেজাল, সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, জনগণকে সরকারি সেবা প্রধান, খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ২৫টি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। জনগণ ট্যাক্স দেয় সেবা পাওয়ার জন্য। সেবা দেওয়া প্রতিটি সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব। সে জন্য সেবার মনোভাব নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে দায়িত্ব পালন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণসহ ২৫টি নির্দেশনা বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জেলা প্রশাসকদের কিছু বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার পরামর্শ দেন। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে। নিয়মিত নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা বাড়াতে হবে। সুইচগেট বা অন্য কোনো কারণে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতার জন্য যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। সেবাপ্রত্যাশীদের সন্তুষ্টি অর্জনই যেন হয় সরকারি কর্মচারীদের ব্রত। প্রধানমন্ত্রী তার ২৫ দফাদার মধ্যে ১৯ দফায় সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, পাহাড়, প্রাকৃতিক জলাশয় প্রভৃতি রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং ২০ নং দফায় নিয়মিত নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা বাড়াতে হবে। সুইচগেট বা অন্য কোনো কারণে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতার জন্য যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারি তহবিল ব্যবহারে কৃচ্ছ্র সাধন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠদান কার্যক্রমের মানোন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে জেলা প্রশাসকদের। জেলা প্রশাসক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যের দাবিদার। জেলা প্রশাসকরা জেলা পর্যায়ে সরকারের চোখ এবং কান হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও জনসেবায় সরকারের কর্মপরিকল্পনা কতটা সফল হবে তা জেলা প্রশাসকদের যথাযথ পদক্ষেপ ও নজরদারির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। চলতি জেলা প্রশাসক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের এক বছর আগে। করোনাভাইরাস ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব যখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন এমন এক দুঃসময়ে।

আমাদের গ্রামে প্রবাদ আছে, তা হলো- ‘শালিসী মানি তাল গাছটি আমার’। নির্দেশনা যতই থাকুক না কেন মানা না মানা তা আমার ব্যপার; কুষ্টিয়ার একটি আলোচিত ঘটনা, তা হলো আদালতের স্থগিতাদেশ থাকার পরও ১২৩ কোটি টাকার সম্পত্তি ১৫ কোটি টাকায় নিলামে বিক্রির ঘটনায় গত ১১ আগস্ট কুষ্টিয়ার ডিসি মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, এসপি মো. খায়রুল আলম ও সদর থানার ওসি মো. সাব্বিরুল আলমকে তলব করেন হাইকোর্ট। ডিসি সাইদুল ইসলাম ওইদিন আদালতে হাজির হলে তাকে সতর্ক করে বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি কেএম রবিউল হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, আপনারা চাকচিক্যময় জীবনযাপন করেন। কীভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করে থাকেন, সেটাও জানি। দুঃখজনক হলেও সত্য, ডিসি অফিসে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারেন না। সাধারণ মানুষ তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান না। আপনাদের অফিসের দরজা-জানালা মোটা পর্দায় আবৃত থাকে। যার কারণে মানুষ আপনাদের ছবি পর্যন্ত দেখতে পান না।’ আদালত বলেন, ‘আপনাকে সতর্ক করছি। এখন থেকে ডিসি অফিসের দরজা-জানালা খোলা রাখবেন, যেন জনগণ আপনাদের চেহারা দেখতে পান। আপনার দরজা-জানালায় ভারী পর্দা ব্যবহার করবেন না। কারণ ডিসি হলো সরকারের হার্ট। আপনাকে জনগণের জন্য সেভাবে কাজ করতে হবে।’

আদালত বলেন, ‘ডিসি অফিসে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নাই। আপনারা একটা দরখাস্ত পর্যন্ত রিসিভ করেন না। এখন থেকে কোনো ধরনের উন্নাসিকতা দেখাবেন না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভালো কাজ করলে দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে। কোথাও চুরি-ডাকাতি হচ্ছে, সরকারি সম্পত্তি দখল হয়ে যাচ্ছে- অভিযোগ না পেলে কি আপনি বসে থাকবেন? বসে থাকার সুযোগ নাই।’

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রীট পিটিশন নম্বর ১৩৯৮৯/২০১৬ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের দৈত বেঞ্চের রায়ে উল্লেখ করেন, ‘জনসাধারণের উপকারার্থে রাষ্ট্রের নিকট গচ্ছিত সম্পত্তিকে পাবলিক ট্রাষ্ট সম্পত্তি বলা হয়। পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র, সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র, নম নদী, খাল- বিল, হাওর-বাওর, ঝিল, সমুদ্র সৈকত, নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত, টিলা, বন এবং বাতাস পাবলিক ট্রাষ্ট সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত। এসব সম্পত্তি সকল নাগরিকের, কোন একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়। ভবিষ্যতে আরও অনেক বিষয় পাবলিক ট্রাষ্ট সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত হবে বিধায় এর সংজ্ঞা প্রদান করা সম্ভব নয়। পৃথিবীব্যাপী নতুন নতুন অনেক বিষয় পাবলিক ট্রাষ্ট সম্পত্তি হিসেবে প্রতিনিয়ত অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।

পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র, জলাভূমি, সমুদ্র, নদ-নদী, খাল, বিল, হাওর, সমুদ্র সৈকত, নদীর পাড়, বন এবং বাতাস প্রকৃতি প্রদত্ত উপহার, প্রকৃতি প্রদত্ত আশির্বাদ। এসবকে অবশ্যই সকলের নিকট বাধাহীন ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। এ সকল সম্পত্তি হয় সকলের নয়তো কারো নয়। পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র, সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র, নদ-নদী, খাল, বিল, হাওর, ঝিল, সমুদ্র সৈকত, নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত, টিলা, বন এবং বাতাস সাধারণ জনগণের মুক্ত এবং বাধাহীন ব্যবহারের জন্য রাষ্ট্র সংরক্ষণ বা ব্যবস্থাপনা করবেন। এখানে রাষ্ট্র অছি বা ন্যাসরক্ষক বা ট্রাটি হিসেবে তথা আইন সম্মত রক্ষাকারী বা পরিচালনাকারী হিসেবে উক্ত পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব- "বৈচিত্র, সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, বন, পাহাড়-পর্বত, টিলা ও বন্যপ্রাণী ইত্যাদি পাবলিক এই সম্পত্তি রক্ষ নিরাপত্তা বিধান এবং উন্নয়ন করবেন।’এসব সম্পত্তি হলো জনগণের ন্যাস সম্পত্তি তথা জাতীয় সম্পত্তি। বরগুনার পাথরঘাটায় খাল ভরাটি জমি পাথরঘাটা কলেজ প্রকাশ্য দিবালোকে ঘর উত্তোলন করলেও ওই সম্পত্তি ‘এ সকল সম্পত্তি হয়সকলের নয়তো কারো নয়’ উচ্চাদালতের নির্দেশনা না মেনেই কাজ করা হয়েছে। প্রশাসনের নজরে আনার চেষ্টা করলেও কোন কাজের কাজ হয়নি। ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ইউএনও। এ রকমের একটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোন কাজ সম্পাদিত করতে হলে অবশ্যই সভায় সভাপতির উপস্থিতিতে সিদ্ধান্তের আলোকেই হয়ে থাকে। তাহলে কিভাবে একজন ইউএনও সরকারি খাস সম্পত্তিতে ঘর উত্তোলনের অনুমতি দেয়? আর কিভাবে একজনের সঠিক প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ডিসিআর প্রদান করে? খাল ভরাটি জমি অকৃষি খাস জমি বলে দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য পাথরঘাটা পৌরসভা জনস্বার্থ বিঘ্নিত হবেন না মর্মে অনাপত্তিপত্রও দিয়েছেন। তাহলে স্থানীয় সরকারের কাজই বা কি? যেখানে স্থানীয় পর্যায় নাগরিকদের সকল ধরণের সুযোগ-সুবিধা এবং নাগরিক সেবা নিশ্চিতের দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের। তাহলে এ দিয়ে কি বুঝা যাচ্ছে, যেখানে এসকল সম্পত্তির রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রশাসনের এবং প্রাপ্যতার দিক থেকে রেকর্ডীয় ও কবলা সম্পত্তির মালিক, মালিকানা হিসেবে দাবিদার অথচ তাদের প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। নদী রক্ষা কমিশন থেকে ওই সম্পত্তি উদ্ধারের ব্যপারে ডিসিকে লিখিতভাবে অবহিত করলেও কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। দেশের নদী রক্ষা, জলালয় ও খাস সম্পত্তি সংরক্ষণ এবং নদী দখল রোধে সরকার ও উচ্চাদালতের কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ডিসিরা মানছেন না। আদালতের নির্দেশনার পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব ও কার্যাবলী-২০১১ প্রজ্ঞাপনের ১৫ দফায় সম্পত্তি অধিগ্রহণ এবং হুকুম দখলের সুস্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে ডিসিদের ওপর।

পরিশেষে বলতে চাই, একটি গণতান্ত্রিক দেশ গণতান্ত্রিক পন্থায় পরিচালিত হয়ে থাকে আর আইন ও সরকারের সঠিক নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী অর্থাৎ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। আমাদের বিশ্বাস জেলা প্রশাসক সম্মেলন থেকে পাওয়া দিকনির্দেশনাগুলো জেলা পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা সফলভাবে বাস্তবায়ন করলে সরকারের পক্ষে বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা সহজ হবে। স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় প্রশাসন যৌথভাবে নাগরিকদের সকল ধরণের সেবা নিশ্চিতে একসাথে কাজ করবেন এটাই একজন নাগরিক হিসেবে প্রত্যাশা করছি। তাতেই দেশবাসীর জন্য বয়ে আনবে স্বস্তি।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

প্রকাশিতঃ দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, নয়া শতাব্দি, প্রতিদিনের বাংলাদেশ, সারাবাংলা ডটনেট

মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০২২

উপকূলের জীবন-জীবিকা: দারিদ্র্য বাড়াচ্ছে উপকূলের নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি



:শফিকুল ইসলাম খোকন:

উপকূল ঘূরে এসে: আলেয়া বেগম, বয়স ৩০-এর কোটায়। অভাবের সংসারে মাছ ধরা থেকে শুরু করে ভারী কাজ করছেন।

কয়েক মাস আগে তার জরায়ু অপারেশন করা হয়। একই এলাকার রোকেয়া বেগমের ৬ মাস আগে জরায়ু অপারেশন হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তান স্থানীয় দাইয়ের দ্বারা ডেলিভারি করান পারভীন বেগম। তখন জরায়ু ব্যথা শুরু হলে ঠিক সময় চিকিৎসা না নিতে পারায় ইনফেকশন হয়। এক পর্যায় তা কেটে ফেলতে হয়। এমন চিত্র এখন প্রায় নারীদের। কেউ সাহস করে বলছে কেউ গোপন রেখে মরণব্যাধি ক্যান্সারেও আক্রান্ত হচ্ছেন।

ভোর রাত থেকেই দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত নারীরা সমান তালে কাজ করছে। সংসারের কাজ সামলিয়ে শীত আর গরম উপেক্ষা করে মাছ ধরা থেকে শুরু করে খেয়ে না খেয়ে পেটের দায়ে পেটে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জ্বর, হাশি, কাশি ও চর্ম জাতীয় রোগের মতো স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এমন চিত্র দেখা যায় উপকূলীয় পাথরঘাটা উপজেলার একাধিক মৎস্য পল্লীতে। দারিদ্র্যের যাতাকলে নিষ্পেষিত নারী স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও তাদের দিকে কেউ খেয়াল রাখেনা। অসচেতনতা, অসাবধানতা এবং ভারী কাজের কারণেও জরায়ুসহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ছে।

সুন্দরবন সংলগ্ন বলেশ্বর নদ ঘেষা পাথরঘাটা উপজেলায় শতভাগ মানুষই কোনো না কোনোভাবে মৎস্য পেশার সঙ্গে জড়িত। গভীর বঙ্গোপসাগরে কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্ত বয়সের পুরুষরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকার করছে। আর বলেশ্বর ও বিষখালী নদীতে এখানকার নারীরাও সমানতালে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করছে। সংসারের সকল কাজ সামলিয়ে মাছ ধরা ও শুটকি মাছ শুকানো উপকূলের নারীদের নিত্যদিনের সঙ্গী। দারিদ্র্যের যাতাকলে নিষ্পেষিত হয়েও দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে নিয়তি যাদের নিয়ে যায় হাড়ভাঙা কর্মে।  

অধিকাংশ নারীর মতে, ভারী কাজ, সন্তান প্রসবকালীন গ্রাম্য দাইদের অদক্ষতা, মাসিকের সময় অসচেতনতার কারণে জরায়ু থেকে শুরু করে গাইনী নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। পাথরঘাটা নতুন বাজার, বিএফডিসি বাজার, রুহিতা, পদ্মা, লালদিয়ার চর, টেংরা, মাছেরখাল, হাজিরখালসহ একাধিক জায়গায় প্রতিদিনই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন নারীরা।

নদ-নদী থেকে আহরিত চিংড়ি, লইট্টা, পুঁটি, বাতাসী, চেলা, মলা, ঢেলা, টাকিসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরে এবং তা কুলে এনে বাছাইয়ের কাজ করছে এখানকার নারী। উপকূলের প্রান্তিক জনপদে দেখা যায় এমন হাজারো চিত্র। সকাল থেকে রাত অব্দি উপকূলের মৎস্য পল্লীতে শুঁটকি উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত থাকেন নারী শ্রমিকরা। দারিদ্র্যতার কারণেই উপকূলের নারীরা এসব ঝুঁকির কাজে যেতে বাধ্য হচ্ছে। শুকনো মৌসুমে পানির তীব্র সংকট দেখা দিলে দূর থেকে কলসিতে করে পানি আনাসহ নানা ভারী কাজ করে। নারীদের শরীরে অনেক চাপ পড়ে ফলে যথা সময় অর্থের অভাবে চিকিৎসা নিতে পারছেন না।

সরেজমিনে বলেশ্বর নদ পাড়ের রুহিতা গ্রামের শুটকি পল্লীতে কাজ করা নারী পারভীন বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘সকাল থেইকা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাম করি। আবার রাইতে সংসারের কাম করি। শরীরে কিছুই থাহে না। রোগ-শোক মোগো জীবনের সঙ্গী। ডাক্তার দেহাইলেও কাম অয় না। ’ 

একই এলাকার আমেনা বলেন, শুটকির দুর্গন্ধে পেটে নানাবিধ ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, এলার্জি রোগে ভুগছি। অভাবের কারণে মাছ ধরাসহ ভারী কাজের করতে গিয়ে অনেক আগেই জরায়ু কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে। বল্বেশর নদ পাড়ের খাদিজা, সুলতানা, মরিয়ম, ফিরোজা বেগমসহ অসংখ্য নারী ওই শুঁটকি পল্লীতে মাছ বাছাই শুকানোর কাজ করেন। তারা আরও জানান, দৈনিক ১০০-১৫০ টাকায় উপার্জন করে।

কথা হয়, দেশের বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বিএফডিসিতে কাজ করা ৫০ বছরের আলেয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাত ৪টা থেকে মাছ বাছা শুরু করি। শীতের সময় অনেক কষ্ট হয়। তারপরেও পেটের দায়ে কাজ করতেই হবে। দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে কাজ করলে পা ফুলে যায়। এছাড়াও হাত ও পায়ের মাংস পেশিতেও অনেক সমস্যা হয়।

পাথরঘাটায় চারটি বেসরকারি কিনিকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালে প্রায় শতাধিক নারীর জরায়ু অপারেশন হয়েছে। তাদের তথ্য মতে, এখানকার নারীরা ভারী কাজ, প্রসবকালীন গ্রাম্য দাইদের দ্বারা ডেলিভারি করানো এবং ডেলিভারির কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই ভারী কাজ শুরু করা। যার ফলে এটি বেশি হয়ে থাকে।

এ বিষয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) চর্ম রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান বাংলানিউজকে বলেন, মাছ বাছাই ও শুটকি তৈরি কাজে পেটে ব্যথা, চর্ম জাতীয় নানা রোগ হয়। অনেকদিন ধরে এ অভ্যাসের কারণে হাতের চামড়া শুষ্ক ও খসখসে হয়ে যায়। এর ফলে চুলকানির সৃষ্টি হয় এবং ত্বক মোটা হয়ে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ত্বকের রোগ অ্যাকজিমা সৃষ্টি হয়। এ দুর্গন্ধযুক্ত কাজে দীর্ঘস্থায়ী থাকলে ক্যান্সার এবং গ্যাংরি রোগের ঝুঁকি থাকে।

প্রতিকারের বিষয় তিনি বলেন, নিরাপত্তার জন্য হ্যান্ডগ্লাভস, মাথায় ক্যাপ এবং শরীরে সুতি সাদা কাপড় পরা উচিত। এছাড়াও কাজের ফাঁকে বারবার পানি ব্যবহার ও সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) গাইনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. লুৎফা বেগম লিপি বলেন, নারীদের এমনিতেই ভারী কাজ করা শরীরের জন্য ঝুঁকি। এর মধ্যে যদি হয় মাসিকের সময় তা তো আরও ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে উপকূল অঞ্চল বা নিন্ম আয়ের মানুষদের একটা বড় অংশই ঝুঁকির কাজ করে থাকেন। এর ফলে জরায়ুর সমস্যা বড় আকার ধারণ করে। তাছাড়া প্রজনন স্বাস্থ্য সুরাক্ষায় মাসিকের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা গুরুত্বপূর্ণ। উপকূল অঞ্চল বা নিন্ম আয়ের নারী এ সময়টা কাপড় ব্যবহার করে। তাছাড়া কড়া রোদে না শুকিয়ে ময়লা বা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় শুকায়। এতে করে প্রজনন অঙ্গের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে। এতে করে নারীদের নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়। তলপেটে ব্যথা, সাদাস্রাব, মাসিকের সময় অধিক রক্তপাত, বিয়ের পরে স্বামীর সঙ্গে সহবাসে ব্যথা এমনকি স্থায়ীভাবে বন্ধ্যত্বও হতে পারে। অনেক সময় ইনফেকশন বেশি হলে ক্যান্সার ঝুঁকিও থাকে।

তিনি আরও বলেন, গ্রাম্য দাইদের দ্বারা নরমল ডেলিভারি করানো, ডেলিভারির পরপরই ভারী কাজ করা, পিরিয়ডকালীন শারীরিক সম্পর্কসহ নানা কারণে জরায়ুর সমস্যা হতে পারে। সঠিক সময় চিকিৎসা না নিলে এক পর্যায়ে জরায়ু অপারেশন করতে হয়। এ ক্ষেত্র দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। 

মঙ্গলবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

মুক্তিযুদ্ধ:নতুন প্রজন্মের দিা গ্রহণ

শফিকুল ইসলাম খোকন 

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনের এমন এক অধ্যায়- যাকে কোনো কিছু থেকেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। না যাপিত জীবনে, না মননের েেত্র। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের প্রেরণা। দীর্ঘদিন পরাজিত, দমিত, দলিত জনগোষ্ঠীর আত্ম-আবিষ্কারের নাম মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মূলে রয়েছে তরুণ সমাজের সংগ্রাম ও স্বপ্ন। এ বিজয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিত্বের চেতনা, ধর্মনিরপেতা, সমাজতন্ত্রের চেতনা, গণতন্ত্রের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলে এসব চেতনার কথাই আমাদের মনে জাগে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর যত শাসক এসেছে তারা সুকৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহার করতে চেয়েছে এবং অসম্মান ও মযর্দাহীন করেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ায় ইতিহাসও কিছুটা বিকৃত হয়েছে এটি অস¦ীকার করার কোন সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা এর সঠিক ইতিহাস বিরাজমান রাখতে বয়স্কদের যেমন বিশেষ দায় আছে তেমনি নতুন প্রজন্মের দায়িত্বের পাশাপাশি দায়বদ্ধতাও রয়েছে। 

৫০ বছর পেরিয়ে গেল স্বাধীন বাংলাদেশ, এখনো আমাদের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করার দায়িত্ববোধ হয়নি এমনকি যারা এর ধারক বাহক তাদেরও জানানোর দায়িত্ব সেটিও বেমালুম ভুলে গেছে। যদিও আওয়ামীলীগ সরকার এসে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক েেত্র সম্মান দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতা ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করেছেন, মুিক্তযোদ্ধা সন্তানদের অধ্যয়নরত প্রত্যেককে ১ হাজার ৫০০ হারে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। সবশেষ ‘মুজিববর্ষে কেউ গৃহহীন থাকবে না’ সরকারের এমন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বীর নিবাস’র ১৪ হাজার থেকে ৩০ হাজার করা হয়েছে। এ দিয়ে শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিকভাবে স¦াবল¤ি¦ করা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন,  মুক্তিযুদ্ধের স¥ৃতি ধরে রাখতে নতুন প্রজন্মের জন্য কি করা হয়েছে? এ জন্য সংশ্লিষ্টদের এখন নতুন করে ভাবতে হবে, স¦াধীনতার ৫০ বছরে এসে দেড়ি হলেও ভাবার এখনই সুযোগ। শুধু বিজয়ের বা স¦াধীনতার মাস কেন সব সময়ই নবীনদের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে হবে এবং জানতেও হবে।  এ জন্য ২০১৪ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধকে জানি’ দেশের একবারে দনিাঞ্চলে নতুনদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার জন্য কাজ করছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বা মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ স্বাধীনতার েেত্র যে অবদান রয়েছে এ বিষয় আমি পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। তাদের ত্যাগ, অবদান মূল্যায়ন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান, শ্রদ্ধা করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মনে-প্রাণে লালন করা বীরদের সম্মানের েেত্র যে শুধু ভাতা দেওয়া, আবাসন দেওয়া এমনটা নয়, এমনকি এটি শুধু যে সরকারের কাজ এমনটাও নয়। আমাদের জনগণের প্রত্যেকের নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব এবং কর্তব্য মনে করে কাজ করতে হবে। তা নাহলে একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে দাবি করা বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে; মুক্তিযোদ্ধাদের মনে-প্রাণে ভালোবাসা, সম্মান ও মূল্যায়ন করাই হলো আমাদের কাজ।

মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যুগযুগ ধরে স্মরণীয় রাখতে এমন প্রস্তাব হতে পারে যেমনÑস¦াধীনতার পর থেকে স¦াধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পালন হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে আজ পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স¥রণে আলাদাভাবে কোন দিবস পালন হয়নি এ জন্য ১ ডিসে¤¦র ‘মুক্তিযুদ্ধ দিবস’ পালন, প্রতিটি উপজেলায় স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্সে ‘মুক্তিযুদ্ধের যাদুঘর’ তৈরি, প্রতিটি শিাপ্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুসহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরণ ও মুক্তিযুদ্ধের কর্নার করা, যদিও বঙ্গবন্ধুর কর্নার রয়েছে, উপজেলাভিত্তিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় শিার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ‘গল্পে গল্পে মুক্তিযুদ্ধ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সচেতন করা, প্রতিটি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ির সামনে রাস্তার নামকরণ, বধ্যভূমিগুলো আধুনিকায়ন করে প্রকৃত ইতিহাস স¤¦লিত স্তম্ভ তৈরি করা, প্রতি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার দিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ প্রকাশনা প্রকাশ করা। অবদান স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে ইতিহাস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের বিষয় জানাতে এর বিকল্প নেই। এ কাজের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা থাকবেন। একদিন মুক্তিযোদ্ধা থাকবে না, থাকবে শুধু স্মৃতি। 

পরিশেষে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে সে বিষয়টি নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের অনুধাবন করতে হবে। এখন সময় এসেছে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। স্বাধীনতার প-বিপ চিহ্নিত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত একটি তরুণ প্রজন্ম গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। নতুন প্রজন্ম সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। এর মাধ্যমে একটি গতিশীল জাতি গঠিত হবে এবং এগিয়ে যাবে নতুন প্রত্যাশায়। নতুন প্রজন্ম হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি আধুনিক প্রজন্ম, যারা বাস্তবায়ন করবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।


Sapia also caught fish at the age of 60


Sapia Begum was married at a young age, but happiness did not last long. Now run the family by fishing. Shafiqul Islam Khokon is expressing his grief over this woman from Patharghata in Barguna

 It had been raining heavily since morning. On the way from Patharghata municipal town to Wapda in Charduani village of the taluk via Kanthaltali, I suddenly saw a woman.

 At the age of sixty. Wearing cotton sari. Condition in the rain. Fishing with nets in the canal flowing along the road. I went ahead out of curiosity. He looked at his face once to ask the name. Later he picked up the fish from the net and said, 'Dad, my name is Sapia. Husband, there is no Polapan. The fish runs slowly (holding) the stomach. 'Since the morning, he has been weak in catching fish soaked in rain. As soon as he spoke, he sat down on the ground.

Happiness is not in the forehead

Sapphire was born into a poor family. Panta furat to bring salt in the world. He did not have the good fortune to go to school. At a young age, one has to get married. She was married in 1979 to Jalal Ahmed Talukder of Auliarpur area of ​​Galachipar in Patuakhali. After marriage, the family was living happily. But within a few years, the in-laws started torturing her mentally. 'Apaya' slander is on his forehead. Gradually the husband also started torturing. Sapia did not have children even after 10 years of marriage. The husband sent Sapia to her father's house for this 'crime'.

 But Sapia's father was not well. The responsibility is to run one's own stomach. The girl has fallen on him. Sapia said, 'After leaving me, I took my wife's claim to my husband a few times, but they chased me away. '

 At one stage Sapia moved to Khulna with some of her savings. There he started selling drinks. He lived in the house of an acquaintance. He bought 13 percent of the land at one time by saving money from the sale of betel. Later he started cultivating shrimp in that land. But the influential people of the area took possession of his fish farm. Sapiya was once expelled from the area with slander. Sapia returned to Patharghata. There, in a corner of the house of Shahjahan Talukdar of Charduani, Sapiyar settled in a hut. Still staying there. And in the surrounding canals and beels, he is fishing with jhankijal and selling whatever he gets. He harvests paddy in winter and makes mung beans. Sometimes he also works in other people's house.

  Sapphire's house

Dochala is a hut. Shelter with palm leaves and polythene. The fence of the house is made of palm leaves. When it rains, water falls on the leaking rice. During the winter, the gap between the fence melts and the wind blows into the canyon. But in the language of Sapia Begum, this is her 'paradise'. This is his peace. At least at the end of the day you can sleep. Champa Begum is one of the family members of Sapia. Said, 'The man (Sapia) is very simple. She works as a maid in another's house and catches fish. We try to give if we need anything. Upazila Nirbahi Officer Hussain Muhammad Al-Mujahid said, "We will try to provide employment to Sapia by making her a house or shop on behalf of the government." And if I don't get old age allowance or widow allowance, I will try to give it too. '

-Shafiqul Islam Khokon

বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

প্রেস কাউন্সিল হোক সাংবাদিক উৎসাহের একটি প্রতিষ্ঠান


শফিকুল ইসলাম খোকন


একটি প্রচলিত কথা দিয়ে এ লেখাটি শুরু করছি, সেটি হলোÐ ‘‘একটি বহুতল ভবন তৈরী করতে হলে ভিত মজবুত করতে হয়’’তেমনি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে টেকসই বা মজবুত হতে হলে আগে গণ

তন্ত্রের মুল মন্ত্র বা ভিত মজবুত করতে হবে অর্থাৎ গণতন্ত্রের মুল মন্ত্র বা গণতন্ত্র বলতে যা বুঝায় সেটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলেই একটি রাষ্ট্র সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে বাধ্য। আর সেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যে কয়টি খুটির উপরে দাঁড়িয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম খুটি হচ্ছে গণমাধ্যম। 

দেশের উন্নয়নকে টেকসই, গতিশীল ও অংশগ্রহণমূলক করতে অবাধ তথ্যপ্রবাহের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান সরকার অনুসৃত এ অন্যতম মূলমন্ত্র বাস্তবায়নে কাজ করছে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল। সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করার দৃঢ়প্রত্যয় সে কাজেরই অংশ। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের কার্যকর ভূমিকায় দেশের সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থা কর্তৃক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের ফলে জনগণ একদিকে উন্নয়নমূলক কাজের বিষয়ে আরও সচেতন হচ্ছে, অন্যদিকে জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি সম্পর্কে সরকারও অবহিত হচ্ছে। এ ছাড়া হলুদ সাংবাদিকতা পরিহার করে সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা ও সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে আরও সচেতন হচ্ছেন। পাশাপাশি ২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর সাংবাদিকদের পুরস্কৃত করায় সাংবাদিকদের উৎসাহ বাড়াচ্ছে প্রেস কাউন্সিল। 

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা ও মানোন্নয়নে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল এখন আগের তুলনায় অনেক গতিশীল এবং দায়িত্বশীল হয়েছে। হলুদ সাংবাদিকতা রোধে প্রেস কাউন্সিলে দায়েরকৃত মামলাগুলো অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি করে বিচারপ্রার্থীর আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের প্রেস কাউন্সিল আন্তর্জাতিকভাবেও যোগাযোগ ও সমন্বয় রক্ষা করে চলেছে। ভারত ও নেপালের সঙ্গে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও প্রশিক্ষণ সহায়তার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব প্রেস কাউন্সিলসের নির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। 

আমরা কথায় বলে থাকি “সাংবাদিকরা চতূর্থ রাষ্ট্র; সাংবাদিকরা জাতির বিবেক, জাতির আয়না, দর্পন” 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাংবাদিকরা ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করছে' ইত্যাদি। আর এই সংবাদিকরাই সংবাদপত্র বা কোন গণমাধ্যমের কর্মী হিসেবে কাজ করেন। একজন সংবাদকর্মী থেকে একজন সাংবাদিক; সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের সাথে আমরা সকলেই পরিরিচত। সংবাদ পত্র হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পন। সংবাদপত্র থেকে জাতি তথা রাষ্ট্র উপকৃতই হয়। সংবাদপত্র যেমন রাষ্ট্রের গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখে, তার অবাদ বিচরণ ও স¦াধীনতাও যেমন থাকা দরকার দায়িত্বশীলতাও রয়েছে। সংবাদপত্র নৈতিকতার চর্চা করে। বিবেকের শাসন করে। সমাজ তথা রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করতে পারে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোথায় কীভাবে নৈতিকতার স্খলন হচ্ছে সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় গণমাধ্যম।  

আগেই বলেছি, গণমাধ্যম দেশের গণতন্ত্রের খুটির অন্যতম একটি। ভবনের প্রয়োজনীয় একটি খুটি না থাকলে যেমন ভবনটি নড়বড়ে হওয়ার পর স্থায়ীত্ব থাকে না, ঠিক তেমনি একটি দেশে ‘গণমাধ্যম’ নামক খুটি যদি নড়বড়ে থাকে, তাহলে গণতন্ত্রও প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। এ কারণেই গণমাধ্যম যেমন থাকার প্রয়োজন রয়েছে,  তেমনি এ খুটির দায়িত্বও রয়েছে অনেক। দায়িত্বের পাশাপাশি বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ ধারায় সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, চিন্তা এবং বিবেকের স্বাধীনতা দান করা হইল। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে- প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। 
গণমাধ্যম কর্মীদের বা সাংবাদিকদের সংগঠিত করার জন্য বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে। যার মধ্যে প্রেসক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, রিপোর্টাস ইউনিটসহ বিভিন্ন নামে। গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে ‘প্রেস ইনস্টিটিউট’ নামে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠন। এর পাশাপাশি গণমাধ্যম কর্মী বা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনায়নের জন্য ‘প্রেস কাউন্সিল’ নামে আরও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মনে করেন সংবাদ তাদের বিরুদ্ধে প্রচার বা প্রকাশিত হয়েছে তারা সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম বা গণমাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘প্রেস কাউন্সিল’ এ অভিযোগ করতে পারেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আইন বা বিধিও রয়েছে। সাংবাদিকরা যদি তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনও ধরনের নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হন তাহলেও তারা প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করতে পারবেন। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা ও মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আইন প্রণয়ন করেন এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল গেজেট প্রকাশের দিনটিকে ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দিবস’ হিসাবে পালন করে থাকে। ২০১৭ সাল থেকে ১৪ ফেরুুয়ারি ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দিবস’ হিসেবে পালন করা শুরু করে। সাংবাদিকরা সব সময়ই দেশ ও দশের কথা প্রকাশ করে। সমস্যাÐসম্ভাবনা, দুর্নীতিÐঅনিয়ম গণামধ্যমের মাধ্যমে দেশ ও জাতির কাছে তুলে ধরেন। কিন্তু সাংবাদিকদের নিয়ে গণমাধ্যমে তেমন কোন সংবাদ প্রকাশ হতে দেখা যায়না। ২০১৭ সালে এসে ১৪ ফেরুুয়ারি ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দিবস’ পালন করা শুরু করে আর ৩ মে ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’ নিয়ে নামমাত্র লেখালেখি হয়। কিন্তু সেটিও আশানুরুপ নয়; আমি মনে করিÐ সারা বছরই সাংবাদিকরা লেখেন জাতির স¦ার্থে। অন্তত বছরের এ দুটি দিন শুধুমাত্র সাংবাদিকদের জন্য উম্মুক্ত করা হোক এবং জেলা উপজেলায় না হলেও কেন্দ্রীয়ভাবে সাংবাদিকদের মহা সমাবেশ ঘটনো হোক। যেটি হতে পারে সাংবাদিকদের মহামিলন এবং একে অপরের প্রতি আত্মার সম্পর্কের একটি অধ্যায়; সেটির বড় ভুমিকা রাখতে পারেন সম্পাদক, গণমাধ্যমের মালিক পক্ষ প্রেস কাউন্সিল বা প্রেস ইনস্টিটিউট। 

সংবিধানের ২ উপধারাটিকে বিশ্লেষনের দিকে দেখা যায়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও এখানেও কিছু শর্ত মানতে হবে। সেগুলো হলো- এমন কিছু সংবাদ মাধ্যমে আসতে পারবে না; যার জন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। এমন কিছু প্রকাশ করা যাবে না; যার জন্য বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে। জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়- এমন তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। অশালীন এবং অনৈতিক কিছু সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না, সবসময় আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং এমন কিছু প্রকাশ করা যাবে না, যার জন্য কেউ অপরাধ করার জন্য প্ররোচিত হতে পারে। এসব শর্ত মেনে নিয়েই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়ে থাকে। এসব শর্তের লঙ্ঘন হলে আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ সংবিধানের এ ধারাটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পেছনে গভীর তাৎপর্য বহন করে। কারণ বাংলাদেশে এখন যতটুকু স্বাধীনতা বিদ্যমান, তার প্রায় পুরোটাই সম্ভব হয়েছে সংবিধানে এ ধারাটি যোগ করে। সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে যেমন মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে; তেমনি গোপনীয়তার অধিকারের কথাও বলা হয়েছে। মত প্রকাশ করতে গিয়ে এমন কিছু করা উচিত নয়; যার জন্য একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা ব্যাহত হয়। জানার অধিকার এবং গোপনীয়তার অধিকারের মধ্যে সবসময় একটি ভারসাম্য রেখে চলতে হয়।

গণমাধ্যমের দেখভাল করার জন্য দায়িত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘প্রেস কাউন্সিল’। প্রশ্নও আসতে পারে ‘প্রেস কাউন্সিল’ গণমাধ্যম বা গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যপারে কতটুকু দায়িত্ব পালন করছে বা করেছে? যাক এ প্রশ্নের উত্তরটি আপাতত খোজার ইচ্ছা নেই; তবে গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে গণমাধ্যকর্মীদের অধিকার চাইতে পারি প্রেস কাউন্সিলের কাছে। প্রেস কাউন্সিল আর গণমাধ্যম বা গণমাধ্যকর্মীদের সাথে সম্পর্কটা থাকা উচিত ভালো, যেটি হবে সাংবাদিক তৈরী করার একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে একে অপরের সাথে সৌহার্দপুর্ণ সম্পর্ক এবং বিপদেÐআপদে একে অপরের পাশে থাকবে। প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৭৪-এর ১১ নম্বর ধারায় কাউন্সিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘প্রেসের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থাসমূহের মান সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা’। কার্যাবলীতে বলা হয়েছে, সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা। সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থাসমূহের স্বাধীনতা সংরক্ষণে সহায়তা করা; সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থা এবং সাংবাদিকদের রুচি বা পছন্দের উচ্চমান সংরক্ষণ নিশ্চিত করা; প্রেস কাউন্সিল বিগত বছরে এমন কাজ কতটা করেছে? আমার মনে হয় বিগত বছরে প্রেস কাউন্সিল তাদের আইন অনুযায়ী শতভাগ কাজ করতে না পারলেও আশানুরুপ কাজ করেছেন। এখানে একটি বিষয় উলে­খ না করলেই নয়Ð বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির যুগ। বিশ্বের সাথে বাংলাদেশ তথ্য প্রযুক্তিতে এগিয়ে রয়েছে। যার মাধ্যমে অনলাইন গণমাধ্যমও রয়েছে এগিয়ে। প্রেস কাউন্সিল আইনে অনলাইন বিযষও অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজনীয়তা যেমন দেখা দিয়েছে, তেমনি প্রেসকাউন্সিল প্রতি বছর প্র্রেসকাউন্সিল দিবসে সাংবাদিকদের সম্মাননা দেন তাতেও তাদের অনলাইন নিউজ পোর্টালে কর্মরত সাংবাদিকদেরও এর আওতায় আনা উচিত। 

৬ ফেরুয়ারি প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘সাংবাদিকরা দায়িত্ববোধ থেকে বিবেকের তাগিদে দেশের জন্য কাজ করছে, মানবতার কাজ করছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাংবাদিকরা ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করছে। রাষ্ট্র যতদিন থাকবে, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ সাংবাদিকতাও থাকবে।’ আমি তার কথায় সম্পুর্ণ একমত, কিন্তু প্রেসকাউন্সিল কতটুকু সাংবাদিকদের জন্য এগিয়ে আসছেন? হ্যা, যতটুকু আসছেন তাতে আশানুরুপ নয় বলে আমি মনে করি। কারণ সাংবাদিকরা অন্যের ঢোল পিটায় কিন্তু নিজের ঢোল পিটাতে পারেনা। আমরা দেখছি, সংবাদপত্র, টিভি ও অনলাইন গণমাধ্যমে সাহিত্যিক, ফিচার,শোবিজ, প্রযুক্তি, ফ্যাশন ইত্যাদি পাতা থাকে কিন্তু সাংবাদিকদের জন্য কোন পাতা দেখা যায়না। প্রেসকাউন্সিল এমন একটি উদ্যোগ নিবেন যাতে করে যারা অন্যের জন্য ঢোল বাজায় তাদের জন্য প্রতিটি গণমাধ্যমে অবদান, সফতলা নিয়ে আলাদা বিভাগ বা পাতা করা হোক। 
গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করার যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি দায়িত্ব রয়েছে দেশের প্রতিও। আর সেই দায়িত্ববোধের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে গণমাধ্যমের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী এবং ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই। ইতোমধ্যেই সারাদেশের সাংবাদিকদের তালিকা প্রণয়ন ও সংরক্ষনের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, এটি প্রশংসনীয়। আইনের পাশাপাশি সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্যও উদ্যোগি হয়ে দায়িত্ব নেয়া উচিত প্রেস কাউন্সিলকে। অনেক বছর পর হলেও ২০১৭ সাল থেকে প্রেস কাউন্সিল প্রতি বছর যে ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দিবস’ পালন করছে। পাশাপাশি ‘প্রেস কাউন্সিল দিবস’ এ ৪ ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সাংবাদিকদের পুরস্কৃত করছে। প্রতি বছর দিবস আর দিবসের মাধ্যমে সাংবাদিকদের পুরস্কৃত করা সত্যিকার অর্থে যেমন প্রশংসনীয় তেমনি সাংবাদিকদের কাজের গতি বাড়িয়ে দেওয়া এবং দায়িত্বশীল হওয়ার একটি সুগম পথ; পাশাপাশি প্রেস কাউন্সিল এবং সাংবাদিক দুটো একই প্রাণের দুটি ডানা। যেহেতু তথ্য প্রযুক্তির যুগে এখন গণমাধ্যমও এগিয়ে, তাই প্রান্তিক জনপদের মানবিক স্টোরি, ফিচার, প্রান্তিক জনপদের সফলতা, উদ্যোক্ততাদের নিয়ে লেখা সাংবাদিকদের প্রতিযোগিতার আওতায় আনা উচিত। তাছাড়া এখন প্রান্তিক জনপদে অনেক মেধাবি সাংবাদিক, লেখক, গবেষক রয়েছেন যারা প্রতিনিয়তই জাতির জন্য ভালো কিছু লেখালেখি করছেন তাদেরকেও বিশেষ ক্যাটাগরিতে এ প্রতিযোগিতায় অন্তর্ভূক্ত করা উচিত। তারা সব সময়ই মিডিয়ার অন্তরালে থাকে।  আমি মনে করি, একটি স¦াধীন রাষ্ট্রের প্রতি গণমাধ্যমের দায়িত্ব আর প্রেস কাউন্সিলের দায়িত্ব হওয়া উচিত পরিপুরক। সাংবাদিকদের প্রতি প্রেস কাউন্সিলের ভুমিকা থাকাটাও উচিত প্রশংসনীয় পর্যায়। ভবিষ্যতে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের অভিভাবক হিসাবে প্রেস কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে এবং সাংবাদিক উৎসাহের একটি প্রতিষ্ঠান  হিসেবে সারাদেশে পরিচিতি লাভ করবে বলে আশা করছি। 

সর্বপরি, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সঠিক পথে চালাতে হলে শুধু যে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব তা নয়, এখানে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। এ কারণে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব যেমন পাঠক, সচেতনসহ আপমর জনসাধারণ তেমনি রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের। সাংবাদিকরা কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা না করলে পৃথিবীর অবস্থা আরো খারাপ হতো। এক্ষেত্রে তরুণ ও উদীয়মান সাংবাদিকদের মেধা, বিদ্যা-বুদ্ধি সততা এবং যোগ্যতার মাধ্যমে দেশ সেবায় দক্ষতার পরিচয় রাখতে হবে। সরকারকেও সংবাদপত্র তথা এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য অবহেলা আর দায়সারা নয়, নিজের দায়বদ্ধতা থেকে দায়িত্ব নিয়ে শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাইÐ স¦াধীন বাংলাদেশটির সুনাম রক্ষা করা যেমন নাগরিক হিসেবে সকলের দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি গণমাধ্যম, প্রেস কাউন্সিল বা প্রেস ইনস্টিটিউটেরও দায়িত্ব রয়েছে। তাই গণমাধ্যম, প্রেস কাউন্সিল এবং প্রেস ইনস্টিটিউটের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগে একটি টেকশই বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত করা কোন ব্যপারই না। তাই এ সকল প্রতিষ্ঠান তাদের সুনাম রক্ষা এবং দেশের সুনাম রক্ষার জন্য উদ্যোগি হয়ে কাজ করবে এবং প্রেস কাউন্সিলই হোক সাংবাদিক তৈরীর প্রতিষ্ঠান এটাই কামনা করছি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকতে এটাই অঙ্গীকার হোক, বঙ্গবন্ধু যে স¦প্ন নিয়ে ১৯৭৪ সালে প্রেসকাউন্সিল গঠন করেছিলেন, সেটিই বাস্তবায়ন করতে হবে। 

লেখক: সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক
প্রকাশিতঃ দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, প্রতিদিনের সংবাদ, দৈনিক সংবাদ, অনলাইন পিবিএ, প্রথম কলকাতা, প্রকাশিত তারিখঃ ১৪ ফেরুয়ারি ২০২০

নদী মরলে দেশও মরবে

: শফিকুল ইসলাম খোকন : নদীমাতৃক দেশে নদীই আমাদের ভরসা। নদী আমাদের হৃৎপিণ্ড, নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না, প্রকৃতি বাঁচবে না, পরিবেশের সুরক্ষা ...