শফিকুল ইসলাম খোকন

বুধবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

ডাকসু নির্বাচন হয় না কেন?

শফিকুল ইসলাম খোকন


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য দায়িত্ব পাওয়া উপাচার্য ড. অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেছিলেন, ‘ঋধরৎ ংবধঃ ঃরসব অর্থাৎ বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। উপযুক্ত সময়েই বীজ বপন করতে হয়। একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাজীবনে সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। যেমনটা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।’ এ কথাটির সঙ্গে আমি কেন, দেশের শতভাগ মানুষই একমত হবেন। সত্যিকার অর্থেই উপযুক্ত সময়ই সঠিক কাজ করতে হয়। তা না হলে সারা জীবনই কাঁদতে হয়। এ কথাটি শুধু মানুষের বেলায়ই প্রযোজ্য নয়Ñ ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান, সমাজ বা রাষ্ট্রে

র জন্যও। যেমনটি উপযুক্ত সময়ে সঠিক নির্বাচন না হওয়ায় আজ ‘ডাকসু’ কাঁদছে। এ কাঁদাটা শুধু এক নয়, দুই নয়, ২৭ বছর ধরে চলছে। কিন্তু এ কান্না কেউ থামাচ্ছে না বা থামাতে পারছেও না। অনেকের কান্না দেখে শান্তি পায় কেউ কেউ। আবার অনেকেই চাইছেন ডাকসু নির্বাচন হোক, কিন্তু কাজের কাজ কেউ করছেন না। 

(একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবকিছু গণতান্ত্রিকভাবেই হওয়া উচিত। এ গণতন্ত্রের পেছনে ডাকসুর অনেক অবদান রয়েছে। এ অবদানের কথা চিন্তা করে আশা করছি, নতুন উপাচার্য পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ না করে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেবেন। শীর্ষপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা যেহেতু সবাই চান ডাকসু নির্বাচন হোক, সে কারণে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ড. আখতারুজ্জামান একজন মডেল হতে পারেন। তাহলে ঢাবি একটি নতুন রূপে আগামী দিনগুলো অতিবাহিত করতে পারবে)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) গঠিত হয় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসে এক ঘটনাবহুল অবদান রাখে এ সংগঠনটি। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং পরবর্তী সময় স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার ও সামরিকতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ ডাকসু।
ডাকসু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। এ প্রজন্মের অনেকেই এ শব্দের সঙ্গে পরিচিত নয়। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, হয়তো তারা কিছুটা পরিচিত। কিন্তু অনেকেই জানে না ডাকসু কী, কী তার দায়িত্ব। এ প্রজন্মের কাছে ডাকসু হয়ে গেছে ইতিহাস। এ সংসদের মাধ্যমে নির্বাচিত হন শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি, যারা দায়িত্ব পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় দেখভালেরÑ তা সে শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই হোক আর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পদ্ধতির স্বচ্ছতাই হোক। নিয়মমতো এ সংসদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার কথা থাকলেও শেষ অবধি তা দেশ-জাতির প্রয়োজনে ছাড়িয়েছে তার সীমা। ডাকসুর অবদানের কথা ভোলার নয়। ডাকসু দিয়েছিল ’৫২, দিয়েছে ’৬৯, দিয়েছে ’৭১। শুধু কি স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা, না তা নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাঙালি শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেয়া অপশাসন-স্বৈরশাসককে রুখে দিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন জাগেÑ ডাকসু এতকিছু করার পরও দীর্ঘ ২৭ বছরেও কেন নির্বাচন হয়নি? নির্বাচন না করার কারণগুলোইবা কী? এক্ষেত্রে আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন ও শিক্ষক সমাজকে প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্রীয় কাঠামো এবং শিক্ষার্থীদের অবস্থানকে পরিকাঠামো হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে এ ‘কেন’ ও ‘কারণ’ খুঁজে বের করার কাজটি অনেকটাই সহজ হবে বলে মনে হয়।

গণতন্ত্রের নামে মুখে মুখে খই ফুটিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো ঢালাওভাবেই বলে যাচ্ছেন ডাকসু নির্বাচন চাই। কিন্তু মুখেই শুধু বলে যাচ্ছেন, বাস্তবে কেউ এগিয়ে আসছেন না। এর আগে দেখেছি, রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, উপাচার্য, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এমনকি ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছাত্র সংগঠনগুলোসহ সবাই চায়, তারপরও ২৭ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হচ্ছে না। কিন্তু কেন? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাকসু নির্বাচন দিতে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মোঃ আবদুল হামিদের তাগিদকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এরপরও ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ না নেয়ায় অজানা রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। ২৭ বছরেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়াকে ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বৈরতান্ত্রিক’ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হওয়াটাই স¦াভাবিক।

লক্ষণীয়, ১৯৯০ থেকে বিভিন্ন সময় ডাকসু নির্বাচনের ‘মুলা ঝুলিয়েছেন’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিরা। কিন্তু তা শুধু ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। ২০১৭ সালে এসেও তা বাস্তবতার মুখ দেখেনি। জানা গেছে, ১৯৯০ সালের ৬ জুন সর্বশেষ নির্বাচনের ১ বছর পর ১৯৯১ সালের ১২ জুন তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। তখন ছাত্রনেতারা ছাত্রত্ব ঠিক রেখে প্রার্থী হওয়ার জন্য বিশেষ ভর্তির দাবি করেন। এ নিয়ে সৃষ্ট সহিংসতায় নির্বাচন ভেস্তে যায়। ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে সে সময়ের ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ডাকসুর তফসিল ঘোষণা করেন। কিন্তু নির্বাচনের পরিবেশ না থাকার দোহাই দিয়ে ছাত্রলীগের বাধার মুখে নির্বাচন স্থগিত হয়। ১৯৯৫ সালেও ডাকসুর তফসিল ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সেবারও একইভাবে নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৯৬ সালে অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ভিসির দায়িত্ব নেয়ার পর একাধিকবার ডাকসু নির্বাচনের সময়সীমার কথা জানান। কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় ব্যর্থ হন। ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু হলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ছাত্রদল নেতা আরিফ হোসেন তাজ খুন হন। ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ১৯৯৮ সালের ২৩ মে রিপোর্ট দেয়। রিপোর্টে তখনকার মেয়াদোত্তীর্ণ ডাকসু ভেঙে দেয়া এবং পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করা হয়। সে অনুযায়ী ওই বছর ২৭ মে সিন্ডিকেট সভায় ডাকসু ভেঙে দেয়া হয়। এরপরও অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী দুইবার নির্বাচনের উদ্যোগ নেন; কিন্তু তা-ও আলোর মুখ দেখেনি। তৎকালীন উপাচার্যের দাবি, সে সময়ের বিরোধী ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের অসহযোগিতার কারণেই ডাকসু নির্বাচন দেয়া সম্ভব হয়নি। সবশেষ চলতি বছর ১৯ মার্চ বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠানে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। শিক্ষা সচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর, রেজিস্ট্রারসহ বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে; কিন্তু তাতেও কোনো কাজের কাজ হয়নি।

রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আচার্য মোঃ আবদুল হামিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে (৫০তম) বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন ইজ আ মাস্ট (হতেই হবে)। নির্বাচন না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে।’ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও ডাকসুর পক্ষে তার অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিভিন্ন সময় তার বক্তব্যে ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে অবস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন। সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ, বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ফ্রন্টসহ ক্যাম্পাসে সক্রিয় সব ছাত্র সংগঠনই ডাকসুর দাবি জানাচ্ছে। (সূত্র : দৈনিক যুগান্তর, ১২ আগস্ট, ২০১৭)। এত দাবি, এত চাওয়া, তারপরও কেন নয় পাওয়া? কেন হচ্ছে না ডাকসু নির্বাচন? বাধা কোথায়? এতকিছুর পরও আশা ছাড়া যাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যবিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের গেল ২৪ আগস্ট মেয়াদ শেষ হওয়ায় ড. অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে ৪ সেপ্টে¤¦র নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মোঃ আবদুল হামিদ। তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ৬ সেপ্টে¤¦র। নিয়োগ পাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য আখতারুজ্জামান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গণতান্ত্রিক ও সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান। এখানে দলমতের ঊর্ধ্বে থেকেই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে চাই।’ (সূত্র : দৈনিক আমাদের সময়, ৬ সেপ্টে¤¦র, ২০১৭)। তিনি আরও বলেন, ‘ঋধরৎ ংবধঃ ঃরসব বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। উপযুক্ত সময়েই বীজ বপন করতে হয়। একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাজীবনে সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। যেমনটা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।’ (সূত্র : বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর.কম)। ভিসি আখতারুজ্জামানের কথার ওপর একমত হয়ে অনেক দেরি হলেও আশা ছাড়ছি না। আমরা আশা করছি, তিনি ডাকসু নির্বাচন দেয়ার বিষয়ে বড় ভূমিকা রাখবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অনেক দিন সহ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেক্ষেত্রে প্রশাসনের কোথায় কী দুর্বলতা ও অব্যবস্থা আছে, তা তার অজানা নয়। তিনি সেসব নিরসনে সচেষ্ট হলে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা পাবেন বলে আশা করা যায়। তার প্রথম দায়িত্ব হবে আগের উপাচার্যের সময় শিক্ষক নিয়োগসহ বিভিন্ন বিষয়ে যেসব অনিয়মের অভিযোগ এসেছে, সেগুলো নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করা। দ্বিতীয়ত, ডাকসু নির্বাচন দেয়া। তার সহযোগীদের মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞান বিতরণ নয়, জ্ঞান উৎপাদনেরও জায়গা। 

পরিশেষে বলতে চাই, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবকিছু গণতান্ত্রিকভাবেই হওয়া উচিত। এ গণতন্ত্রের পেছনে ডাকসুর অনেক অবদান রয়েছে। এ অবদানের কথা চিন্তা করে আশা করছি, নতুন উপাচার্য পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ না করে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেবেন। শীর্ষপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা যেহেতু সবাই চান ডাকসু নির্বাচন হোক, সে কারণে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ড. আখতারুজ্জামান একজন মডেল হতে পারেন। তাহলে ঢাবি একটি নতুন রূপে আগামী দিনগুলো অতিবাহিত করতে পারবে। 

(শফিকুল ইসলাম খোকন সাংবাদিক, কলামিস্ট ও স্থানীয় সরকার গবেষক)
msi.khokonp@gmail.com

মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

রোহিঙ্গা:প্রত্যাবাসনে ঐক্য অনৈক্য

শফিকুল ইসলাম খোকন

অনেকদিন পরে হলেও মানসিকভাবে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। যার কারণ হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের হত্যাযজ্ঞ যেমন থেমেছে, তেমনি সু চির সরকার এর দায়ও স্বীকার করেছে । আর আমরা সৌভাগ্যবান যে, মানবতাকে ভুলুণ্ঠিত করিনি, বিশ্বের কাছে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ আজ ইতিহাসে স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন বাকি কাজ হচ্ছে, দ্রুত নিরাপদে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়া। এ দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশ সরকারের নয়, সু চির সরকারেরও।


রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয় দেশের রাজনৈতিক দল থেকে অনেক বিরূপ মন্তব্যও শোনা গিয়েছিল। সবশেষে আগামী দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্য চূড়ান্ত করে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ। এ বিষয়টি সত্যিকার অর্থে একটি সুসংবাদ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের দীর্ঘ বৈঠকে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর দুই পক্ষ এতে স্বাক্ষর করে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সম্মতিপত্র এবং যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের দলিলের (টার্মস অব রেফারেন্স) ভিত্তিতে সম্মতিপত্র স্বাক্ষরের ৫৪ দিনের মাথায় ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চূড়ান্ত হলো। ১৯৯২-৯৩ সালের চুক্তিকে ভিত্তি করে সমঝোতা স্বাক্ষরিত হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা কিছু সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে এ চুক্তি সংকট পুরোপুরি কাটাতে খুব একটা সহায়ক হবে না বলে মন্তব্য করেছিলেন। অন্যদিকে পোপ যখন ভ্যাটিকান থেকে উভয় দেশ সফরে আসেন, তার প্রাক্কালে তাড়াহুড়া করে এ রকম চুক্তিকে অগোছালো কূটনীতির পরিচায়ক বলেও উল্লেখ করেছিলেন তারা। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়াটাই মূল কথা।

জানা যায়, রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ের জন্য একটি ফরমও চূড়ান্ত করা হয়েছে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে। প্রতিটি পরিবারকে একটি ইউনিট ধরে পরিচয় যাচাই ও প্রত্যাবাসনের কাজটি হবে। অনাথ ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় জন্ম নেওয়া শিশুদের প্রত্যাবাসনের বিষয়েও বলা হয়েছে চুক্তিতে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে যে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে, তাদের দিয়েই প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারেÑএমন আভাসও মিলেছে। চুক্তি অনুযায়ী, সীমান্তে পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্প খুলবে বাংলাদেশ। সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে রাখা হবে মিয়ানমারের দুটি ক্যাম্পে। সাময়িকভাবে তাদের থাকার ব্যবস্থা হবে হ্লা পো কুংয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পে। পাশাপাশি ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ভিটামাটিতে দ্রুততার সঙ্গে বাড়িঘর পুর্র্নিমাণের ব্যবস্থা নেবে মিয়ানমার। মিয়ানমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাদের বাসিন্দাদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ করারও ব্যবস্থা নেবে দেশটি।

আগে বলা হয়েছিল, সরকার কর্তৃক প্রদানকৃত নিজেদের পরিচয়পত্র যারা দেখাতে পারবে তাদের গ্রহণ করবে দেশটি। এর মধ্যে থাকবে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ‘সাদা কার্ড’ কিংবা ‘সাদা কার্ড’ জমা দেওয়ার রসিদ। কিন্তু এ পদ্ধতি কতটা সফলভাবে কাজ করবে, এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। মিয়ানমার প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ভালো করেই জানেন, অনেক রোহিঙ্গাই এসব শর্ত পূরণ করতে পারবে না। কারণ তাদের অনেকের কাছেই পরিচয়পত্র কিংবা প্রমাণপত্র নেই। আবার অনেকে হয়তো মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার সময় হারিয়ে ফেলেছে। হয়তো অল্প কিছুসংখ্যকের কাছে থাকতে পারে। পরিচয়পত্র ছাড়াও প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গারা তাদের নাম, পরিবারের সদস্যদের নাম, মিয়ানমারে কোথায় বাস করত সেখানকার ঠিকানা, জন্মতারিখ ও ফিরে যাওয়ার স্টেটমেন্ট দিতে হবে। আমরা মনে করি, চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমার যাতে তাদের নাগরিকদের মর্যাদার সঙ্গে দ্রুত ফিরিয়ে নেয়, সে ব্যাপারে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত রাখাও জরুরি।

রোহিঙ্গাবিষয়ক তথ্যাদি সতর্ক হয়ে পর্যালোচনা করে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, রোহিঙ্গা মুসলিমদের টার্গেট করে চালানো সহিংসতা জাতিগত নিধন বৈ কিছু নয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণকে সমর্থন করেছিলেন। বলা যায়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে শরণার্থীদের ফেরত নিতে সম্মত হয় মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের ঘরে ফেরার পথ তৈরি করতে গত বছরের ২৩ নভেম্বর নেপিদোতে দুই দেশের মধ্যে একটি সম্মতিপত্র স্বাক্ষর হয়।

এদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানা যায়, সম্প্রতি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের দায় স্বীকার করেছেন সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান সু চি ও সেনাপ্রধান মিন অং লেইং। তাদের দায় স্বীকার করায় এটি ইতিবাচক হিসেবে বিশ্লেষকরা গ্রহণ করেছেন। ফেসবুক পাতায় এক পোস্টে সু চি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশের জন্য এ এক নতুন ধাপ। আমি বিষয়টিকে এভাবেই দেখি। কারণ দেশে আইনের শাসনের জন্য একটি দেশের দায় নেওয়াটা জরুরি। আর সেই দায় নেওয়ার পথে এটিই হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ। এটি একটি ইতিবাচক ব্যাপার।’ দায় স্বীকার ও চুক্তির পরও বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমন থেমে নেই। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, দায়সারা প্রত্যাবাসন চুক্তিকে মিয়ানমারের সেনারা মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। দেশটির সেনাদের নির্যাতন অব্যাহত থাকায় পালিয়ে তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রত্যাবাসন চুক্তির পর ৭৫ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ না হলে চুক্তি অনুযায়ী একদিকে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত গেলেও তার চেয়ে বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে। উদ্বেগের বিষয় হলো, ফিরে গিয়ে কতটা স্বস্তিতে থাকতে পারবেÑএ ব্যাপারেও শঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশে আশ্রিত অনেক রোহিঙ্গা। তারা ফিরে গিয়ে যাতে মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করাও জরুরি। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে যাতে নিরাপদে বসবাস করতে পারে, তার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে সব পক্ষের দায়িত্ব পালন করা উচিত। এ বিষয়ে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এটাই স্পষ্ট যে, মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত না থাকলে দেশটি নানা কৌশলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করবে, যা কোনোমতে গ্রহণযোগ্য নয়।

আমরা বলতে চাই, প্রত্যাবাসন চুক্তির পরও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে। মিয়ানমার নানাভাবেই রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা বলে স্বীকৃতি না দিয়ে বাঙালি হিসেবে দেখছে। বিষয়টিরও মীমাংসা হওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি। আবার রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে গেলে তাদের সহায়তার পরিবর্তে সামরিক বাহিনী পদে পদে বাধা দিতে পারে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যে মাত্রায় সহিংসতা ও বর্বরতার অভিযোগ রয়েছে, সেখানে এ ধারণা অমূলক নয়। সর্বোপরি প্রত্যাশা করব, চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ‘নিরাপদ’ হোক। পাশাপাশি ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সে দেশে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
msi.khokonp@gmail.com 
সুৃত্রঃ প্রতিদিনের সংবাদ, প্রকাশের তারিখঃ ২০ জানুয়ারি ২০১৮

সোমবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

নগর সরকারের কথা বলছেন না কেন?

শফিকুল ইসলাম খোকন 
অভিভাবক ছাড়া যেমন কোনো ব্যক্তি বা পরিবার চলে না, তেমনি সেই অভিভাবকহীন পরিবার আজ অভিভাবক পাওয়ার অপেক্ষা করছে। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে নগরবাসী অতিষ্ঠ। অনেকে বলেন, অপেক্ষায় থাকা বড় কষ্টের। দীর্ঘ এক যুগ পর হলেও সেই অপেক্ষা ও কষ্ট থেকে মুক্ত হতে যাচ্ছে নগরবাসী। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতিমধ্যে প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা নগরবাসীদের দেখাচ্ছেন বাসযোগ্য ও নিরাপদ নগরীর স্বপ্ন। দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। যদিও বিদ্যমান ব্যবস্থায় এসব প্রতিশ্রুতি পালনের সক্ষমতা কারও নেই।

নগরবাসীকে সেবা দেয়ার জন্যই সিটি কর্পোরেশনের জন্ম হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সিটি কর্পোরেশন একক কর্তৃপক্ষীয় কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এছাড়া নগরগুলো (সিটি ও পৌর) একরূপ আইনে পরিচালিত হচ্ছে না। যেমন, ঢাকা নগর উন্নয়নের জন্য পৃথক পৃথক ৬টি বিভাগ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ওয়াসা পানি সরবরাহের জন্য এবং রাজউক বিল্ডিং অনুমোদনের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু পৌর এলাকায় পানি সরবরাহ ও বিল্ডিং অনুমোদনের দায়িত্ব পৌরসভার হাতে ন্যস্ত রয়েছে। সেজন্য একরূপ আইন ও নিয়মে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলো পরিচালিত হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে নগরীয় কাজগুলো এককভাবে করার জন্য নগর কর্তৃপক্ষের হাতে প্রয়োজনীয় জনবল, অর্থবল ও ক্ষমতা প্রদান জরুরি।
বর্তমানে দেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষ শহরে বসবাস করছে। ২০২০ সাল নাগাদ প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এবং ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় গোটা জনগোষ্ঠী শহরবাসী হবে। সেজন্য এখনই দেশের ৩১৯টি নগরকে পরিবেশবান্ধব ও পরিকল্পিত নগরে পরিণত করতে হবে এবং এ উদ্দেশ্যে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এর ফলে গ্রামীণ কৃষি, গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ সমাজ, গ্রামীণ সভ্যতা, গ্রামীণ সংস্কৃতি ও গ্রামীণ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে যথাক্রমে নগরীয় কৃষি, নগরীয় জীবন, নগরীয় সমাজ, নগরীয় সভ্যতা, নগরীয় সংস্কৃতি ও নগরীয় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠতে থাকবে। বর্তমানে বিপুল জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থার পাশাপাশি নগর সরকারের মাধ্যমে প্রতি নগরে নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। ভবিষ্যতের কৃষি হিসেবে নগরীয় কৃষির ওপর গুরুত্বারোপ অব্যাহত রাখতে হবে এবং নগর মানে কৃষি নয়- এমন ক্ষতিকর ভাবনার বিপরীতে কৃষিকে নিয়েই নগর- এই প্রয়োজনীয় ভাবনা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

দ্রত নগরায়ণের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রামভিত্তিক প্রশাসনিক ইউনিটের- ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা- বিলুপ্তি ঘটবে। ফলে সে সময় নগরগুলো বিভাগ/জেলার অধীনে পরিচালিত হবে। তখন গোটা সরকার ব্যবস্থা তিন স্তরবিশিষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ তখন কেন্দ্রীয় সরকার, বিভাগীয়/জেলা সরকার ও নগর সরকার থাকবে। অনেকে সরকারের আকার-আয়তন, স্তর বিন্যাসকরণ, প্রকারভেদকরণ, নগরায়ণ, বিদ্যুতায়ন, পেশাগত পরিবর্তন, শিক্ষার প্রসার, বহুতল ভবন, জনঘনত্ব, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার, সিস্টেম কস্ট, সেবা ও উন্নয়ন কস্টের বিষয়গুলো বিবেচনায় না এনে নতুন নতুন ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও প্রদেশ সৃষ্টির প্রস্তাব করছেন, যা খুবই অপ্রয়োজনীয় বলে প্রতীয়মান হয়। গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখায় উপস্থাপিত সমন্বিত স্তর বিন্যাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, গতিশীল ও সুদূরপ্রসারী বলে আমরা মনে করি।

নগর সরকারে তিনটি বিভাগ থাকবে- নগর প্রশাসন, নগর সংসদ/কাউন্সিল ও নগর আদালত। কাউন্সিলররা নগর সংসদের সদস্য হবেন (বর্তমানে কাউন্সিল না করেই কাউন্সিলর পদ সৃষ্টি করা হয়েছে)। নগর সংসদে নগরকেন্দ্রিক যাবতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে এবং নগর সংসদে পাসকৃত সিদ্ধান্তগুলো নগর প্রশাসন বাস্তবায়ন করবে। মেয়র নগর প্রশাসনের প্রধান হবেন। নগর প্রশাসনের অধীনে দক্ষ জনবল থাকবে (যেমন- প্রকৌশলী, চিকিৎসক, পরিকল্পনাবিদ, নগর পরিবেশবিদ, নগর কৃষিবিদ ইত্যাদি কর্মকর্তা)। নগর প্রশাসনের অধীনে নগর পুলিশ বাহিনীও থাকবে। নগর আদালতের বিচারকরা পৃথকভাবে নিযুক্ত বা মনোনীত হবেন। তারা নগরীয় এলাকায় সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার করবেন। নগর সরকারের বাইরে একজন নগর ন্যায়পাল ও একটি নগর নির্বাচনিক বোর্ড থাকবে। নগর ন্যায়পাল নগর সরকারের তিন বিভাগের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ও দুর্নীতির বিচার করবেন। নগরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচনিক বোর্ড গঠিত হবে। নগর সরকারের মেয়াদ শেষে নগর নির্বাচনিক বোর্ড একক দায়িত্বে নির্বাচন সম্পন্ন করবে।
নগর সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হওয়ার পর নগরীয় এলাকায় ভবন ধস হলে দূরবর্তী কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করার সুযোগ থাকবে না। তবে ইউনিয়নকে দোতলা ভবন, নগরগুলোকে ছয়তলা ভবন এবং তদূর্ধ্ব ভবনগুলোর অনুমোদন দেয়ার ক্ষমতা জেলা সরকারের ওপর অর্পণ করা যেতে পারে। এ রূপরেখার আলোকে সমগ্র সরকার ব্যবস্থাকে সাজানো সম্ভব হলে গণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্থানীয়করণ, পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগর ও নগরায়ণ, সমহারে নারীদের গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নসহ গণতন্ত্রের পক্ষের যাবতীয় কাজ ও চিন্তা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হতে থাকবে, এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।

কৃষি জমি হ্রাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদী ভাঙন, জলবায়ু পরিবর্তন, কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধার আশায় মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে যাচ্ছে। সারা দেশে প্রতি বছর ১.৩৭ ভাগ হারে জনসংখ্যা বাড়লেও নগরগুলোতে জনসংখ্যা বাড়ছে শতকরা ৪ ভাগ হারে। ২০১১ সালে বিশ্বে নগরবাসীর সংখ্যা গ্রামবাসীর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৫১.৩ ভাগ নগরে বসবাস করে। ২০৫০ সালে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ ভাগ নগরে বসবাস করবে। আগেই বলা হয়েছে, দেশে প্রায় ৫ কোটি মানুষ নগরে বসবাস করে। ২০২০ সালে ৫০ ভাগ অর্থাৎ ৮.৫ কোটি মানুষ নগরে বসবাস করবে এবং ২০৫০ সালে দেশের শতভাগ মানুষ অর্থাৎ ২৭ কোটি লোক নগরে বসবাস করবে। তখন নগরই হবে মানুষের স্থায়ী ঠিকানা। আমরা চাইলেও এই অনিবার্য বাস্তবতাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব না।

পরিবেশের প্রতি চরম উদাসীনতা এবং অপরিকল্পিত নগর ও নগরায়ণের কারণে ঢাকা শহর আজকের মরণদশায় উপনীত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে এবং তাতে তাৎক্ষণিকভাবে ১ লাখ মানুষের মৃত্যুর আশংকা রয়েছে। লক্ষণীয়, ঢাকা শহরকেন্দ্রিক একটিমাত্র সরকার ব্যবস্থা থাকার কারণে সমগ্র দেশের মানুষ ঢাকামুখী। তবে বর্তমানে ঢাকা শহরের যে অবস্থা, তা আগামীতে অন্যান্য শহরেও প্রকটভাবে দেখা দেবে, যার আলামত ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সেজন্য দেশের ৩১৯টি শহরে ৩১৯টি নগর সরকার গঠন করে তাদের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ও পরিকল্পিত ৩১৯টি নগর গড়তে হবে এবং তা সবসময় বজায় রাখতে হবে। এতে একদিকে ঢাকা শহরকেন্দ্রিকতা রাতারাতি হ্রাস পাবে এবং অন্যদিকে ঢাকা শহরসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত দেশের ৩১৯টি শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন ভাবনা ও কর্মকাণ্ড পরিচালিত ও বিকশিত হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, আসুন আমরা আমাদের এ দেশটাকে নিজেদের মতো করে গড়ে তুলি। পাশাপাশি একটি পরিকল্পিত এবং দীর্ঘস্থায়ী নগর তথা নগর সরকার বাস্তবায়ন করি।

শফিকুল ইসলাম খোকন : স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক
msi.khokonp@gmail.com

রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

বাংলা ভাষা ব্যবহারে কারপান্যতা কেন?

শফিকুল ইসলাম খোকন

গ্রাম্য ভাষায় একটি কথা আছে, “আগে ঘর ঠিক করো? পরে বাহির” অর্থাৎ আগে নিজের ঘর সামলাতে না পারলে, বাহির (সমাজ) সামলানো সম্ভব নয়; এ কথাটির সাথে আমরা সবাই একমত পোষন করতে পারি। আমাদের এখনো ঘর ঠিক হয়নি; হ্যাঁ বলছি আমার দেশের কথা, আমার ভাষার কথা। ফেব্রুয়ারি বাঙালির চেতনা ও ভাষার মাস। যে কোনো জাতি তার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন
করে। একটি মানবগোষ্ঠী তার উদ্ভবকাল থেকে যতদিন পর্যন্ত সে টিকে থাকছে, ততদিন যাপিত গোষ্ঠীজীবনে অসংখ্য বস্তু-উপাদান ও মনন-কল্পনাজাত ভাব-উপাদানের সম্মিলনে নিজের সংস্কৃতি নির্মাণ করে তোলে। আর সেই ভাষা যদি জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করা হয় সেটি কে না চায়? কিন্তু আমাদের ঘরতো এখনো ঠিক হয়নি।

ভাষার ৬১ বছর পেরুলেও এখনো আমরা মায়ের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা আনতে পারিনি। আমরা বাঙ্গালী, আমরা হাড়তে শিখিনি; কারণ আমরা মাছে-ভাতে বাঙ্গালী, আমরা পিছনের সব কাজেই সফল হয়েছি। ৫২র ভাষা, ৬৯ অভ্যূত্থান, ৭১ এর স¦াধীনতা। তারই ফলশ্রতিতে ২১ফের্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পালিত হচ্ছে গোটা বিশ্বে। তারপরেও আমাদের দেশে মায়ের ভাষাকে মুল্যায়ন করছি না। আমরা বাংলা ভাষাকে পিছনে ফেলে রেখে ইংরেজি ভাষা চর্চা করছি। একবিংশ শতাব্দির জিডিটাল যুগে যেখানে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার সরকারের চেষ্টা চলছে সেখানে আমরা নিজেরাই বাংলার প্রতি শ্রদ্ধা রাখছি না। ভাবতে অবাগ লাগে। ১৯১৮ সালে এক বক্তৃতায় জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন- ‘ আমরা বঙ্গদেশবাসী। আমাদের কথাবার্তার, ভয়-ভালোবাসার, চিন্তা-কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।’ কিন্তু সেই মাতৃভাষাকে আমরা এখনো ভালোবাসতে শিখিনি। আজকের আমরা কী দেখছি- রাস্তা-ঘাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসায় সব েেত্র বাংলার বিপরীতে ইংরেজি ব্যবহার করা হচ্ছে। 

ফ্রেরুয়ারি মাস, ভাষার মাস। রক্তের বিনিময় বাংলা ভাষায় রুপান্তর হয় এদেশ। ভাষার মর্যাদার জন্য রক্তদান কিংবা জীবন বিষর্জন পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল; ফ্রেরুয়ারি মাস আসলেই আমাদের মনে পড়ে যায় ভাষা শহীদদের। এর পরে আর তাদের মনে করি না আমরা। আমরা কতটা স¦ার্থবাদি; যাদের কারণে আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলি, তাদের একটি বারের জন্য মনে করছি না। ফ্রেয়্রয়ারি ভাষা আন্দোলনের সেই আগুনঝড়া মাস। এ মাসেই চূড়ান্তপর্বের দিকে এগিয়ে নিয়েছিল শহীদ, রফিক বরকত আরও অনেকে। ভাষা নিয়ে আমাদের অনেক ইতিহাসই জানা আছে, জানা থাকলেও বাস্তবে চলছে এর ব্যতিক্রম। ভাষা আন্দোলনের ৬১ বছর অতিবাহিত হলো। ৬১বছর আগে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে অস্ত্রের মুখে বুক ঠেলে দিয়েছিলেন বাংলার সাহসী সন্তানরা। একটি বারের জন্যও তারা মনে করেনি এই গুলিতেই তাদের মৃত্যূ হবে। 

১৯৪৭ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র ও অধ্যাপকের উদ্যোগে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এ তমদ্দুন মজলিশ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলাÑ না উর্দু?’ এ নামে একটি পুস্তিকা ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশ করে। এ পুস্তিকাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং তমদ্দুন মজলিশের প্রধান কর্মকর্তা আবুল কাসেম কর্তৃক লিখিত ভাষাবিষয়ক একটি প্রস্তাব সংযোজিত করা হয়। প্রস্তাবটিতে বাংলা ভাষা চালু করার দাবি জানানো হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক নেতৃস্থানীয় ছাত্র ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তারা নতুন ছাত্র সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ল্য, নীতি ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে একটি সার্কুলার প্রচার করেন বাংলায়।

এভাবে বাংলাভাষার জন্য আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এবং তা রক্তয়ী আন্দোলনে রূপলাভ করে। আন্দোলন সফল হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে বাংলা ভাষা। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমী, বাংলা উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শুরু হয় জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম। অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বাংলায় প্রণীত হয় সংবিধান। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের বিধানাবলী পূর্ণরূপে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ‘বাংলাভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ (১৯৮৭ সালের ২ নং আইন) প্রণীত হয়।  

এরপরও কিন্তু বাংলাদেশের অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালুর েেত্র কোন প্রকার বাঁধা থাকার কথা নয়। বাস্তব সত্য যে, বাংলাদেশের অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা পরিপূর্ণভাবে আজও চালু হয়নি। এমনকি উচ্চ আদালতে রায় এবং আদেশ লিপিবদ্ধ হয় ইংরেজীতে। সর্ব েেত্র এখন ইংরেজীকে প্রাধান্য দেয়া হয় বেশি আর বাংলাকে রাখা হয় ইংরেজির পাশাপাশি। অথচ বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাকে রাখার কথা। ১৯৮৭ সালের ২নং আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে এ পর্যন্ত কোন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে শাস্তি দেয়া হয়নি। যদিও উক্ত আইন অহরহ লঙ্ঘিত হচ্ছে। আসলে কাগজে কলমে ভাষা আন্দোলনের স¦াধীন হলেও সত্যিকারের ভাষা আজও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের পিছনের দিকে ফিরে দেখা উচিত- আইন করে কিন্তু বাংলা ভাষা কার্যকর হয়নি; আন্দোলনের মাধ্যমে হয়েছে।  ফের্রুয়ারি মাস আসলেই ভাষার কথা মনে পরে যায়, মনে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার। কিন্তু বাস্তবে সেই শহীদদের মুল্যয়নতো করছি না বরং তাদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্যকেও আমরা ধরে রাখতে পারছি না। 

সকল রাজনীতিবিদ এবং সরকারের প্রতি অনুরোধ- আসুন আমরা সবাই মিলে বাংলা ভাষাকে আরও গতিশীল করি। রাজনীতিবিদরা শুধু মুখেই সব কিছু বলতে পারেন, কিন্তু বাস্তবে তারাই বাংলা ভাষা থেকে বিরত থাকে। ভাষা, সাহিত্য, সং¯কৃতিতে গৌরব ও ঐতিহ্যের অধিকারী বাঙালী জাতি তার মেধা ও মনন দিয়ে আরো বেশি সমৃদ্ধ হবে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন- বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করতে সরকার চেষ্টা করছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি- আগে নিজের ঘর ঠিক না করতে পারলে অন্যের ঘর ঠিক করা সম্ভব নয়। হ্যাঁ আমাদের মায়ের ভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করবেন সেটি অবশ্যই আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়। কিন্তুু আমরা এখনো মায়ের ভাষাকে প্রাধান্য দিতে পারেনি, করতে পারিনি ভাষা শহীদের মুল্যায়ন। আমাদের দেশের প্রত্যেক সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ সকল প্রতিষ্ঠানে আগে মায়ের ভাষাকে বাধ্যতামুলক করা উচিত। 

আমরা মুখে বলি বাংলা ভাষা কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি অন্য। আমরা বাঙ্গালী, আমরা বাংলা সংস্কৃতিকে বিশ্বাস করি। আমরা হারতে শিখিনি। বর্তমানে দেশে বাংলা একাডেমী, বাংলা উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে কিন্তু এতগুলো প্রতিষ্ঠান থাকতেও সত্যিকারের ভাষা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমরা প্রাথমিক শিার দিকে তাকাই; শিার্থীরা বাংলার প্রতি দূর্বল, তারা ইংরেজীতে ফল বেশি পায় বাংলায় পায় তার চেয়ে কম। সত্যিকার অর্থে আমাদেরতো বাংলার বিষয় বেশি ফলাফল আশা করার কথা? দুঃখের সাথে বলতে হয়  যে, ভাষার জন্য আত্মত্যাগের বিনিময় এই দেশে গড়ে উঠতে পারতো একটি আন্তর্জাতিক ভাষা ইনিষ্টিটিউট। বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ নিজ নিজ ভাষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করে কর্মেেত্র কাজ করে থাকেন। অথচ আমাদের দেশে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিতে বাংলা ভাষা আজও দুর্বল। সুতরাং বাংলা ভাষার চর্চা, গবেষণা এবং ভাষার আধুনিকরণ সর্বস্তরে পৌছে দিতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য সরকারকে আরও উদ্যোগি হতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভাষা আন্দোলনের ৬১ বছর অতিবাহিত হলেও বাংলা ভাষার উন্নতি লমাত্রায় পৌঁছেনি। 

স¦াধীনদেশ বাংলাদেশ, বাংলা ভাষার দেশ; কিন্তু আমরা অহরহ দেখে চলেছি সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড, ব্যানার, চাকরীর জন্য জীবন বৃত্তান্ত, চাকরীর জন্য আবেদন, পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন ইত্যাদি সব েেত্র ইংরেজী ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই সকল জায়গায় বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। চাকুরী থেকে শুরু করে সকল পর্যায় জীবন বৃত্তান্ত বাংলায় বাধ্যতামূল করতে হবে। যদিও ইংরেজী ভাষা বিশ্বস¦ীকৃত এবং আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে একি দেখছে মানুষ; বর্তমানে যেভাবে মায়ের ভাষা ছেড়ে দিয়ে ইংরেজি ভাষার দিকে ছুটে চলেছি, তাতে আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মের সন্তানরা কোন দিকে এগোবে সেটি আমাদের ভাবা দরকার! দেশে রাজনীতিবিদ, আমলা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের লোকজন ইংরেজী ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়েছে এমন ভাবে মনে হয় ইংরেজী ভাষা আমাদের মায়ের ভাষা। আমরা একে অন্যের সালামের মধ্যেও ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করে থাকি।  আমাদের মায়ের ভাষাকে প্রযুক্তির সাথে তাল মিলাতে হবে। ইন্টারনেট, ফেসবুকসহ বিভিন্ন নেটওয়ার্কিং প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষাকে অন্তর্ভূক্ত করা উচিত পদ্যতিগতভাবে।  কিন্তু কেন? এ জন্যই কী রক্তের বিনিময় রাষ্ট্রভাষা বাংলায় রূপান্তর করেছে আমাদের বীর শহীদরা। সুতরাং এটি সহজেই অনুমেয় যে, এখনো রাষ্ট্র ভাষা বাংলা সঠিকভাবে রুপান্তরিত হয়নি। ভাষা আন্দোলন বলতে সাধারণতঃ ৫২ এর ভাষা আন্দোলনকেই বুঝায়, কিন্তু প্রকৃত পে মাতৃভাষা নিয়ে ুদ্র ুদ্র আন্দোলন বা সংগ্রাম দেশে বিভাগের অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। তেমনি শুধু ৫২এর আন্দোলনই শেষ নয় এখনো বাংলা ভাষার আন্দোলন শেষ হয়নি। আসুন আমরা সবাই বাংলা ভাষাকে মায়ের মত করে বুকে টেনে নেই। তা নাহলে ভাষা শহীদদের আত্মা হয়তো শান্তি পাবে না। আসুন নিজের মাকে যেমন বুকের ভিতরে আগলে রেখে সম্মান  মর্যাদা দেই, তেমনি বাংলা ভাষা ব্যবহারের েেত্রও কারপন্যতা না করে নিজের মায়ের মতো বুকের ভতরে লালন করে বাংলা ভাষাকে সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করি। 

লেখক- শফিকুল ইসলাম খোকন, সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক
প্রকাশিতঃ দৈনিক যায়যায়দিন, তারিখঃ ৮ফের্রুয়ারি ২০১৬

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮: অপপ্রয়োগ রোধ করতে হবে


::শফিকুল ইসলাম খোকন::

‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।  তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করা হলেও, নতুন আদলে ধারাগুলো অন্ত্মর্ভুক্ত করা হয়েছে নতুন আইনে। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাটি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। নানা সময়ে গণমাধ্যমে সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এ ধারার আওতায় হয়রানির শিকার হতে পারেন, এমন আশঙ্কার বিষয়টিও সামনে এসেছে। এমনকি এ ধারা বাতিলের দাবিতে সাংবাদিকরা আন্দোলনও করেছেন। আর দাবির মুখে ৫৭ ধারা বাতিলের প্রস্ত্মাব করা হলেও ৫৭ ধারায় বর্ণিত অপরাধ ও শাস্ত্মির বিধান পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে বলেই জানা যায়। অনুমোদনের পর আইনটির ব্যাপারে আইনমন্ত্রীও জানিয়েছেন, আইসিটি অ্যাক্টের অপরিচ্ছন্ন যে ৫৭ ধারা ছিল, সেটিকে বিলুপ্ত করার প্রস্ত্মাব করা হয়েছে। তবে ৫৭ ধারার যে অপরাধ, সেগুলো বিস্ত্মারিতভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে।

উলেস্নখ্য যে, নতুন আইনের ১৭ থেকে ৩৮ ধারায় বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্ত্মির বিষয় উলেস্নখ রয়েছে। আর আইনটি পাস হলে ১১ সদস্যের একটি ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল’ গঠন করা হবে, যার প্রধান হবেন প্রধানমন্ত্রী। আইনটির ৩২ ধারা নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে বলেই প্রকাশিত খবরে জানা যায়। এ ধারায় ডিজিটাল অপরাধের বদলে গুপ্তচরবৃত্তির সাজার বিধান রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ঢুকে কেউ কোনো কিছু রেকর্ড করলে, তা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে। প্রথম দফা এ অপরাধ করলে ১৪ বছরের কারাদ- বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- প্রয়োগ করা যাবে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে যাবজ্জীবন কারাদ- বা এক কোটি টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- দেওয়া যাবে। নতুন আইন অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকা-, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা বস্নক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, নতুন আইনের আওতায় কেউ যদি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো ধরনের প্রপাগান্ডা চালায় তাহলে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ধর্মীয় বোধ ও অনুভূতিতে আঘাত করে, তাহলে ১০ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে।

আমরা উলেস্নখ করতে চাই, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হলেও নতুন আইনে আগের মতো হয়রানির আশঙ্কা থাকবে কি-না- এমন প্রশ্নের জবাবে যখন আইনমন্ত্রী বলেছেন, অযথা হয়রানি যাতে না হয়, সে জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। অপপ্রয়োগের সুযোগ ৯৭ ভাগ বন্ধ হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। ফলে এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখা দরকার, আইনের অপ্রয়োগ হলে তা অত্যন্ত্ম আশঙ্কাজনক বাস্ত্মবতাকেই নির্দেশ করে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ৫৭ ধারার আদলে কিছু বিধান রাখা হয়েছে, যা মত প্রকাশের এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বড় বাধা হতে পারে’- যখন এমন আশঙ্কার বিষয়টিও প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে- তখন সামগ্রিকভাবেই এই বিষয়গুলোকেও সংশিস্নষ্টদের আমলে নিতে হবে। ভুলে যাওয়া যাবে না ৫৭ ধারা নিয়ে দুশ্চিন্ত্মার প্রধান কারণ ছিল এর অপপ্রয়োগ। ফলে ধারাটি বিলুপ্ত হলেও যেহেতু বর্ণিত বিষয়গুলো বিভিন্ন ধারার মধ্যে বিন্যাস করা হয়েছে, ফলে আইনের অপপ্রয়োগ রোধ করার বিষয়টি গুরম্নত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার, অপপ্রয়োগ রোধ না হলে মানুষ হয়রানির শিকার হয়, যা সার্বিকভাবেই নেতিবাচক বাস্ত্মবতাকেই স্পষ্ট করে। সর্বোপরি বলতে চাই, কোনোভাবেই যেন আইনের অপপ্রয়োগ না হয় সেটি নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে এমনটি আমাদের প্রত্যাশা।
লেখকঃ সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক
msi.khokonp@gmail.com

প্রেস কাউন্সিল এবং গণমাধ্যম

শফিকুল ইসলাম খোকন

পুরোনো কথা বারবার নতুন করে বলতে ভালো না লাগলেও কখনও কখনও বলতে হয়। কথায় বলে, ‘একটি বহুতল ভবন তৈরি করতে হলে ভিত মজবুত থাকতে হয়’, তেমনি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে টেকসই বা মজবুত হতে হলে আগে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র বা ভিত মজবুত করতে হবে অর্থাৎ গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র বা গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, সেটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তা হলেই একটি রাষ্ট্র সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে বাধ্য। আর সেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যে কয়টি খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গণমাধ্যম।

অধিকাংশের না হলেও কিছুসংখ্যক মানুষের মাঝে গণমাধ্যম কী, এমন প্রশ্ন আসে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম, রেডিও, অনলাইনে যা প্রকাশ বা প্রচার পায়, তা-ই গণমাধ্যম। এক কথায়, গণমানুষের কথা যে মাধ্যমে প্রকাশ পায়, সেটি হচ্ছে ‘গণমাধ্যম’। গণমাধ্যম (Mass media) হচ্ছে সংগৃহীত সবধরনের মাধ্যম, যা প্রযুক্তিগতভাবে গণযোগাযোগ কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সম্প্রচার মাধ্যম, যা ইলেকট্রনিক মিডিয়া নামে পরিচিত, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে তাদের তথ্য প্রেরণ করে। টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, রেডিও বা বেতার, সিডি, ডিভিডি এবং অন্যান্য সুবিধাজনক ছোট ও সহায়ক যন্ত্রপাতি যেমনÑ ক্যামেরা বা ভিডিওচিত্রের সাহায্যে ধারণ করা হয়। পাশাপাশি মুদ্রিত মাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্র, সাময়িকী, ব্রুশিয়ার, নিউজলেটার, বই, লিফলেট, পাম্পলেটে বাহ্য বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয়। এতে ফটোগ্রাফি বা স্থিরচিত্রও দৃশ্যমান উপস্থাপনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

সংবাদপত্র, টেলিভিশন বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া, রেডিও অনলাইনের সঙ্গে পরিচিত হলেও গণমাধ্যমের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নন। আলাদা আলাদাভাবে শব্দগুলো ব্যবহার না করে এক কথায় আমরা ‘গণমাধ্যম’ ব্যবহার করে থাকি বা করা হয়। আর সেই গণমাধ্যম, সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকর্মীদের (সাংবাদিকরা) বলা হয়ে থাকে ‘চতুর্থ রাষ্ট্র; জাতির বিবেক, জাতির আয়না, দর্পণ ইত্যাদি।’ আর এ সংবাদিকরাই সংবাদপত্র বা কোনো গণমাধ্যমের কর্মী হিসেবে কাজ করেন। একজন সংবাদকর্মী থেকে একজন সাংবাদিক; সংবাদপত্র (গণমাধ্যম) হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পণ। সংবাদপত্র থেকে জাতি তথা রাষ্ট্র উপকৃতই হয়। সংবাদপত্র যেমন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তার অবাধ বিচরণ ও স্বাধীনতাও যেমন থাকা দরকার, দায়িত্বশীলতাও রয়েছে। সংবাদপত্র নৈতিকতার চর্চা করে। বিবেকের শাসন করে। সমাজ তথা রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করতে পারে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোথায় কীভাবে নৈতিকতার স্খলন হচ্ছে, সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সংবাদপত্র। এর পাশাপাশি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়েও বহুকাল থেকে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

গণমাধ্যম কর্মীদের বা সাংবাদিকদের সংগঠিত করার জন্য বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে প্রেসক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ বিভিন্ন নামে। গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে ‘প্রেস ইনস্টিটিউট’ নামে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠন। এর পাশাপাশি গণমাধ্যম কর্মী বা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনার জন্য ‘প্রেস কাউন্সিল’ নামে আরও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি মনে করে তাদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচার বা প্রকাশিত হয়েছে, তারা সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম বা গণমাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘প্রেস কাউন্সিল’-এ অভিযোগ করতে পারেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইন বা বিধিও রয়েছে। সাংবাদিকরা যদি তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো ধরনের নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হন, তাহলেও তারা প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করতে পারবেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা ও মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আইন প্রণয়ন করেন এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল গেজেট প্রকাশের দিনটিকে ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। ২০১৭ সাল থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দিবস’ হিসেবে পালন শুরু করে। সাংবাদিকরা সবসময় দেশ ও দশের কথা প্রকাশ করেন। সমস্যা-সম্ভাবনা, দুর্নীতি-অনিয়ম গণমাধ্যমের মাধ্যমে দেশ ও জাতির কাছে তুলে ধরেন। কিন্তু সাংবাদিকদের নিয়ে গণমাধ্যমে তেমন কোনো সংবাদ প্রকাশ হতে দেখা যায় না। ২০১৭ সালে এসে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দিবস’ পালন শুরু করে, আর ৩ মে ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’ নিয়ে নামমাত্র লেখালেখি হয়। কিন্তু সেটিও আশানুরূপ নয়। আমি মনে করি, সারা বছরই সাংবাদিকরা লেখেন জাতির স্বার্থে। অন্তত বছরের এ দুটি দিন শুধু সাংবাদিকদের জন্য উন্মুক্ত করা হোক এবং জেলা-উপজেলায় না হলেও কেন্দ্রীয়ভাবে সাংবাদিকদের মহাসমাবেশ ঘটানো হোক। যেটি হতে পারে সাংবাদিকদের মহামিলন এবং একে অপরের প্রতি আত্মার সম্পর্কের একটি অধ্যায়। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন সম্পাদক, গণমাধ্যমের মালিক পক্ষ প্রেস কাউন্সিল বা প্রেস ইনস্টিটিউট।

আগেই বলেছি, গণমাধ্যম দেশের গণতন্ত্রের খুঁটির অন্যতম একটি। ভবনের প্রয়োজনীয় একটি খুঁটি না থাকলে যেমন ভবনটি নড়বড়ে হওয়ার পর স্থায়িত্ব থাকে না, ঠিক তেমনি একটি দেশে ‘গণমাধ্যম’ নামক খুঁটি যেমন থাকার প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি এ খুঁটির দায়িত্বও রয়েছে অনেক। দায়িত্বের পাশাপাশি বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ ধারায় সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেÑ ‘চিন্তা এবং বিবেকের স্বাধীনতা দান করা হইল। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’

সংবিধানের ২ উপধারাটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও এখানেও কিছু শর্ত মানতে হবে। সেগুলো হলো এমন কিছু সংবাদ মাধ্যমে আসতে পারবে না, যার জন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। এমন কিছু প্রকাশ করা যাবে না, যার জন্য বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে। জনশৃঙ্খলা বিঘিœত হয়, এমন তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। অশালীন এবং অনৈতিক কিছু সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। সবসময় আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং এমন কিছু প্রকাশ করা যাবে না, যার জন্য কেউ অপরাধ করার জন্য প্ররোচিত হতে পারে। এসব শর্ত মেনে নিয়েই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়ে থাকে। এসব শর্তের লঙ্ঘন হলে আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ সংবিধানের এ ধারাটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পেছনে গভীর তাৎপর্য বহন করে। কারণ বাংলাদেশে এখন যতটুকু স্বাধীনতা বিদ্যমান, তার প্রায় পুরোটাই সম্ভব হয়েছে সংবিধানে এ ধারাটি যোগ করে। সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে যেমন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তেমনি গোপনীয়তার অধিকারের কথাও বলা হয়েছে। মত প্রকাশ করতে গিয়ে এমন কিছু করা উচিত নয়, যার জন্য একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা ব্যাহত হয়। জানার অধিকার এবং গোপনীয়তার অধিকারের মধ্যে সবসময় একটি ভারসাম্য রেখে চলতে হয়।

একটি দাবিদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে কি নাÑ এ প্রশ্নে সবার মনে বাসা বেঁধে আছে। সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম একটি পণ্য। তা প্রকাশ বা পরিচালনা করতে পুঁজির প্রয়োজন। এতে যেমন লাভ আছে, তেমনি লোকসানের ঘানিও টানতে হয়। সংবাদপত্রকে ভালো লাগলে মানুষ তা টাকা দিয়ে কেনে। ভালো না লাগলে কেনে না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে বাংলাদেশের মানুষ দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করার আগেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। দেশের অগ্রযাত্রার জন্য সংবাদপত্র যেমন প্রয়োজন, তেমনি সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাও প্রয়োজন। এর সঙ্গে সাংবাদিকের স্বাধীনতাও জরুরি। একজন স্বাধীনচেতা সাংবাদিক, যিনি কোনো পক্ষভুক্ত নন, তার জন্য প্রয়োজন সেরকম একটি সংবাদপত্র, যেখানে পেশাদারিত্ব চলবে। মালিকের হস্তক্ষেপ থাকবে না। আজকাল সংবাদপত্রের মালিকরাই সম্পাদক হচ্ছেন। সারাজীবন পেশায় কাটিয়ে দিয়ে তিনি একজন পুঁজির মালিকের অধীন হয়ে গেলেন। কিন্তু তাতে কি স্বাধীন সাংবাদিকতা হবে? এভাবেই স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ ক্রমে রুদ্ধ হয়ে আসছে। এখানেও যেমন প্রকৃত সাংবাদিকদের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে, তেমনি রাজনৈতিকভাবে তো সাংবাদিকতা ঝুঁকির মধ্যে থাকে সবসময়। রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে সাংবাদিকদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, আর বিরোধী দলে থাকলে সাংবাদিকদের পক্ষে অবস্থান নেয়। গণমাধ্যম বা সাংবাদিকদের স্বাধীনতা দিচ্ছে বলে রাজনীতিকরা মুখে খই ফোটাচ্ছেন; কিন্তু কতটুকু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রয়েছে, সেটি প্রশ্নবিদ্ধ।

এ তো গেল গণমাধ্যমের দায়িত্ব, দায়িত্বশীলতা, স্বাধীনতা ইত্যাদি। কিন্তু গণমাধ্যমের দেখভাল করার জন্য দায়িত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘প্রেস কাউন্সিল’। প্রশ্নও আসতে পারে, ‘প্রেস কাউন্সিল’ গণমাধ্যম বা গণমাধ্যম কর্মীদের ব্যাপারে কতটুকু দায়িত্ব পালন করছে বা করেছে? যাক এ প্রশ্নের উত্তরটি আপাতত খোঁজার ইচ্ছা নেই। তবে গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে গণমাধ্যম কর্মীদের অধিকার চাইতে পারি প্রেস কাউন্সিলের কাছে। প্রেস কাউন্সিল আর গণমাধ্যম বা গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কটা থাকা উচিত ভালো। যেখানে একে অপরের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক এবং বিপদে-আপদে একে অপরের পাশে থাকবে। প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট-১৯৭৪ এর ১১ নম্বর ধারায় কাউন্সিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘প্রেসের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থাগুলোর মান সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা।’ কার্যাবলিতে বলা হয়েছে, সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য সুযোগসুবিধা প্রদান করা। সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থাগুলোর স্বাধীনতা সংরক্ষণে সহায়তা করা; সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থা এবং সাংবাদিকদের রুচি বা পছন্দের উচ্চমান সংরক্ষণ নিশ্চিত করা; প্রেস কাউন্সিল বিগত বছরে এমন কাজ কতটা করেছে? আমার মনে হয় বিগত বছরে প্রেস কাউন্সিল তাদের আইন অনুযায়ী শতভাগ কাজ করতে না পারলেও আশানুরূপ কাজ করেছে। 

গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করার যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি দায়িত্ব রয়েছে দেশের প্রতিও। আর সেই দায়িত্ববোধের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে গণমাধ্যমের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী এবং ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই। এরই মধ্যে সারা দেশের সাংবাদিকদের তালিকা প্রণয়ন ও সংরক্ষণের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, এটি প্রশংসনীয়। আইনের পাশাপাশি সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্যও উদ্যোগী হয়ে দায়িত্ব নেওয়া উচিত প্রেস কাউন্সিলকে। অনেক বছর পর হলেও প্রেস কাউন্সিল প্রতি বছর যে ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দিবস’ পালন করছে, এজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। পাশাপাশি ‘প্রেস কাউন্সিল দিবস’-এ ৪ ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সাংবাদিকদের পুরস্কৃত করছে। প্রতি বছর দিবস আর দিবসের মাধ্যমে সাংবাদিকদের পুরস্কৃত করা সত্যিকার অর্থে যেমন প্রশংসনীয়, তেমনই সাংবাদিকদের কাজের গতি বাড়িয়ে দেওয়া এবং দায়িত্বশীল হওয়ার একটি সুগম পথ; পাশাপাশি প্রেস কাউন্সিল এবং সাংবাদিক দুটো একই প্রাণের দুটি ডানা। আমরা মনে করি, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতি গণমাধ্যমের দায়িত্ব আর প্রেস কাউন্সিলের দায়িত্ব হওয়া উচিত পরিপূরক। সাংবাদিকদের প্রতি প্রেস কাউন্সিলের ভূমিকা থাকাটাও উচিত প্রশংসনীয় পর্যায়। ভবিষ্যতে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের অভিভাবক হিসেবে প্রেস কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, স্বাধীন বাংলাদেশটির সুনাম রক্ষা করা যেমন নাগরিক হিসেবে সবার দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি গণমাধ্যম, প্রেস কাউন্সিল বা প্রেস ইনস্টিটিউটেরও দায়িত্ব রয়েছে। তাই গণমাধ্যম, প্রেস কাউন্সিল এবং প্রেস ইনস্টিটিউটের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগে একটি টেকসই বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত করা কোনো ব্যাপারই নয়। তাই এসব প্রতিষ্ঠান তাদের সুনাম রক্ষা এবং দেশের সুনাম রক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়ে কাজ করবেনÑ এটাই কামনা করছি।

(শফিকুল ইসলাম খোকন
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক
msi.khokonp@gmail.com)
সূত্রঃ দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, তারিখঃ ১৪ ফেরুয়ারি ২০১৮

শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বনাম মুক্তমতের স্বাধীনতা

শফিকুল ইসলাম খোকন আমরা জানি দেশের যেকোনো আইন সার্বজনীন, কোনো ব্যক্তি বা মহলের জন্য আইন তৈরি হয় না। সব আইনই হচ্ছে মানুষের কল্যাণে। কেউ দুর্নীতি, অন্যায় করলে ওই আইনের আওতায় আসবে। সে মন্ত্রী, এমপি, বিচারক, সরকারি কর্মকর্তা, শ্রমিক, এনজিওকর্মী, সাংবাদিক কিংবা কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হোক না কেন। কেউ আইনের ব্যতয় ঘটালে শাস্ত্মির আওতায় আসে বা আসতে বাধ্য। আমরা প্রতিটি নাগরিকই অন্যায়-অপরাধ করতে চাই না ওই সব কাজে জড়াতেও চাই না। আমরা দেশের সব আইনের প্রতিও শ্রদ্ধাবোধ সব সময়ই থাকে বা করতে হয়। কিন্তু সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর ৫৭ ধারা নিয়ে সব মহলে আলোচনা-সমালোচনা বয়ে গেছে। পরে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাসহ বহুল আলোচিত কয়েকটি ধারা বিলুপ্ত করা হলেও ৫৭ ধারায় বর্ণিত অপরাধ ও শাস্ত্মির বিধান পুনর্বিন্যাস করে 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮'-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নতুন আইনের ১৭ থেকে ৩৮ ধারায় বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্ত্মির বিষয় উলেস্নখ রয়েছে। ৩২ ধারায় ডিজিটাল অপরাধের বদলে গুপ্তচরবৃত্তির সাজার বিধান রাখা হয়েছে। আইনটির ৩২ ধারা নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে সব মহলে। আগেই বলেছি, দেশের প্রতি যেমন শ্রদ্ধাবোধ আমার রয়েছে, তেমনি দেশের সব আইনের প্রতিও আমার শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে গঠনমূলক সমালোচনা করার অধিকারও আমার রয়েছে। সমালোচনার খাতিরে একটু বললেই নয় এটি হচ্ছে- আমার নিজ এলাকার সৌদি প্রবাসী মো. মাহমুদ নামে এক যুবক চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল। ওই স্ট্যাটাসে অশস্নীল এবং অপমানজনক লেখা লিখলেও তার বিরম্নদ্ধে আইনি কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এমন স্ট্যাটাস নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সংবাদ সম্মেলনসহ গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও মামলা কিংবা সুয়োমুটো রম্নল করতে দেখা যায়নি। বরং মামলা না করে অপমানের বিচার হলো মাত্র ১০টি জুতার পিটান! অথচ সাংবাদিক আনিস আলমগীরের বিরম্নদ্ধে হিন্দু ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে। আনিস আলমগীর লিখেছিলেন- হিন্দু ধর্ম নিয়ে আর মাহমুদ নামে ওই প্রবাসী যুবক লিখেছিলেন যাদের অক্লান্ত্ম পরিশ্রম এবং জীবনের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে আর সেই স্বাধীন দেশে আমরা বাস করছি, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি। দুজনের অপরাধ একই রকম। দুজনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছে। একটি বাস্ত্মব উদাহরণে কি মনে হয়, আইনে বৈষম্য নাকি অপরাধী ব্যক্তি বিশেষ বৈষম্য? তাহলে আমরা কি বুঝব, অপরাধের শাস্ত্মি নাকি অপরাধীর শাস্ত্মি।   আমার এক সহকর্মী সাংবাদিক ৫৭ বা ৩২ ধারাসহ সাংবাদিকতা নিয়ে বলেছিলেন, 'আমরা জানি একটি পুকুরে মানুষ পড়লেই মারা যাবে অথবা পরে গেলে তার ক্ষতি হতে পারে, তাহলে মারা যাওয়া থেকে বিরত থাকতে ওই পুকুরের চারপাশে ঘুড়াঘুড়ি করার কি দরকার? ওই ধারাগুলোতে যে ব্যাখ্যা রয়েছে ওই সব কাজ না করলেই তো হয়?' আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সাংবাদিকদের কাজ কি? সংবাদ সংগ্রহ করা, সংবাদ পরিবেশন করা, সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা। আইনের ব্যাখ্যায় যা রয়েছে সেটিতে পুরোপুরি ফলো করে বা করতে হয় সাংবাদিকদের। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি ভুয়া আইডিও ব্যবহার করে সম্মানহানিরও স্ট্যাটাস বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে এই আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তার দিকে তাকিয়ে মূল লক্ষ্যভ্রষ্ট সমীচীন নয়। অথচ এসব আইডিতে মানহানিকর স্ট্যাটাসের কারণে চিহ্নিতও হয়নি বা বন্ধ না করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জালে মুক্ত সাংবাদিকদের সাংবাদিকতাকে পেঁচিয়ে গলা কাটা নয় কি? প্রশ্ন হচ্ছে, আইন যদি সার্বজনীনই হয় এবং ৫৭ বা ৩২ ধারা যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এটি লিখলে বা প্রকাশ করলে অপরাধ হয়, তাহলে কেন বিগত বছরগুলোতে শুধু ৫৭ ধারার আওতায় সাংবাদিকরা আসবে, কেনই বা ৫৭ ধারায় শুধুমাত্র সাংবাদিকদের বিরম্নদ্ধে মামলা হবে? এই অপরাধে কজন বস্নগার, সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারকারীদের বিরম্নদ্ধে মামলা হয়েছে? ওই ধারায় তো সাংবাদিক শব্দটি উলেস্নখ নেই? তাহলে কেন সাংবাদিকদের বিরম্নদ্ধে এত মামলা? কথায় বলেনা- অপরাধ নির্মূলের চেয়ে অপরাধ যাতে সংগঠিত না হয় সেগুলো সংগঠিত না করা। কিন্তু আমরা সব সময়ই অপরাধ ঘটার পরেই সব কিছু নিয়ে ভাবি, ঘটার আগে নয়; সাইবার সিকিউরিটি ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত্ম সারাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের হওয়া ৭৪০টি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে ৬০ শতাংশ মামলা রয়েছে ৫৭ ধারায়। ২০১৩ সালে প্রথম তিনটি মামলা হওয়ার পর প্রতি বছর মামলার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৪ সালে সারাদেশে ৩৩টি মামলা হলেও ২০১৫ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫২-তে। ২০১৬ সালে ৫৭ ধারায় মামলা হয় ২৩৩টি, আর ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত্ম এই ধারায় মামলা হয়েছে ৩২৩টি। এর মধ্যে বেশির ভাগ মামলাই সাংবাদিকদের বিরম্নদ্ধে। যা নিয়ে বিগত দিনে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। প্রবীণ রাজনীতিবিদ শ্রদ্ধেও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহম্মেদ একটি কথার সঙ্গে আমিও একমত। তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ নিয়ে বলেছেন- 'এমপিদের মান-ইজ্জত রক্ষা করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। আপনারা (সাংবাদিকরা) গণমাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের বিরম্নদ্ধে রিপোর্ট করেন, তাতে তাদের মান-ইজ্জত থাকে না। তাদের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়। তারা তো জনপ্রতিনিধি। তাই এগুলো ঠেকাতেই এ আইন করা হয়েছে।' (সূত্র : বাংলাট্রিবিউন, তারিখ : ৩০ জানুয়ারি ২০১৭)। শুধু জনপ্রতিনিধি কেন একজন সুইপারেরও মান-সম্মান রয়েছে। তার এ কথা থেকেই মনে হয়েছে কিনা এমপিদের মান-সম্মান রয়েছে, আর কেউর নেই। সাংবাদিকরা শুধু এমপিদের নিয়েই সংবাদ প্রকাশ করে থাকেন, আর কাউকে নিয়ে কিছুই লেখেন না। তার বক্তব্যে মনে হচ্ছে না, এ আইন শুধুমাত্র সাংবাদিকদের গণমাধ্যমে মত প্রকাশের বিরম্নদ্ধে। সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ বা কণ্ঠ রোধ যাই বলিনা কেন- প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৭৪ এবং এর ১১ (বি) ধারা অনুযায়ী প্রণীত সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা এবং সাংবাদিকদের জন্য অনুসরণীয় আচরণবিধি, ১৯৯৩ (২০০২ সাল সংশোধিত) থাকার পর আর কোনো নতুন করে আইনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে যেহেতু দেশসহ বিশ্বজুড়েই তথ্যপ্রযুক্তিতে সয়লাব সে কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রস্ত্মাবিত ওই আইনে সার্বজনীনের পাশাপাশি সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী একটি ধারা থাকতে পারত। সেটি হওয়া উচিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করে। আইনে সাংবাদিকদের কাজকে আলাদাভাবে সন্নিবেশিত না থাকার কারণেই তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৭ ধারা সাংবাদিকদের বেলায় অপব্যহার করা হয়েছিল। প্রস্ত্মাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাসহ বেশ কয়টি ধারাও ঠিক ৫৭ ধারারই অনুসরণ করবে এবং সাংবাদিকরা হয়রানি হবে। ধারা নিয়ে আমার কোনো মতবিরোধ নেই। আমি বরাবরই ৫৭ ধারা কেন সব আইনের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল এবং পক্ষেই ছিলাম। কিন্তু ধারার ব্যাখ্যার বিষয়ে আমার আপত্তি রয়েছে। ইতোপূর্বে ৫৭ ধারায় যত মামলা হয়েছে, তার বেশির ভাগই সাংবাদিকদের বিরম্নদ্ধে। এ কারণেই এত সমালোচনা। বিগত দিনের সমালোচনার আলোকে আমার মনে হয়েছে- '৫৭ ধারাটি মনে হয় শুধুই সাংবাদিকদের জন্য; আসলে ৫৭ ধারা কি সাংবাদিকদের জন্য? ওই ধারায় কি বলা আছে- ৫৭ (১) কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশস্নীল বা সংশিস্নষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরম্নদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ (২) কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি ৫ অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদ-ে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদ-ে দ-িত হইবেন।'?আর প্রস্ত্মাবিত আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের গোপনীয় বা অতিগোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ডিজিটাল নেটওয়ার্ক অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে গোপনে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহলে তা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ বলে গণ্য হবে। এর জন্য ১৪ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদনের পর ফেসবুকে এ নিয়ে দেয়া স্ট্যাটাসে অনেকেই লিখেছেন, নতুন বোতলে পুরোনো মদ। নতুন মোড়কে পুরানো পণ্য, অথবা বোতলটা নতুন, তবে মদটা পুরোনো নয় ইত্যাদি।সংবাদমাধ্যম এবং বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পেশার মানুষের আপত্তির মুখে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন বাতিল নিঃসন্দেহে সরকারের শুভবুদ্ধিরই পরিচায়ক। তবে মন্ত্রিসভায় যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদন করা হয়েছে তাতে ঘুরে-ফিরে ৫৭ ধারা বহাল রাখা হয়েছে কিনা সেটি বড় মাপের একটি প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে সংগতি রেখে স্বাধীন সাংবাদিকতাও এগিয়ে যাবে এমনটাই প্রত্যাশা। সে ক্ষেত্রে এমন কোনো আইন প্রণয়ন করা মোটেও কাম্য হবে না, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত্ম করে কিংবা মানুষের বাক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে। আমরা মনে করি, সংসদে পাস হওয়ার আগে আইনটি আবার বিবেচনা করা হবে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে।
(শফিকুল ইসলাম খোকন: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক)msi.khokonp@gmail.com

নদী মরলে দেশও মরবে

: শফিকুল ইসলাম খোকন : নদীমাতৃক দেশে নদীই আমাদের ভরসা। নদী আমাদের হৃৎপিণ্ড, নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না, প্রকৃতি বাঁচবে না, পরিবেশের সুরক্ষা ...