শফিকুল ইসলাম খোকন

রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

বাংলা ভাষা ব্যবহারে কারপান্যতা কেন?

শফিকুল ইসলাম খোকন

গ্রাম্য ভাষায় একটি কথা আছে, “আগে ঘর ঠিক করো? পরে বাহির” অর্থাৎ আগে নিজের ঘর সামলাতে না পারলে, বাহির (সমাজ) সামলানো সম্ভব নয়; এ কথাটির সাথে আমরা সবাই একমত পোষন করতে পারি। আমাদের এখনো ঘর ঠিক হয়নি; হ্যাঁ বলছি আমার দেশের কথা, আমার ভাষার কথা। ফেব্রুয়ারি বাঙালির চেতনা ও ভাষার মাস। যে কোনো জাতি তার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন
করে। একটি মানবগোষ্ঠী তার উদ্ভবকাল থেকে যতদিন পর্যন্ত সে টিকে থাকছে, ততদিন যাপিত গোষ্ঠীজীবনে অসংখ্য বস্তু-উপাদান ও মনন-কল্পনাজাত ভাব-উপাদানের সম্মিলনে নিজের সংস্কৃতি নির্মাণ করে তোলে। আর সেই ভাষা যদি জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করা হয় সেটি কে না চায়? কিন্তু আমাদের ঘরতো এখনো ঠিক হয়নি।

ভাষার ৬১ বছর পেরুলেও এখনো আমরা মায়ের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা আনতে পারিনি। আমরা বাঙ্গালী, আমরা হাড়তে শিখিনি; কারণ আমরা মাছে-ভাতে বাঙ্গালী, আমরা পিছনের সব কাজেই সফল হয়েছি। ৫২র ভাষা, ৬৯ অভ্যূত্থান, ৭১ এর স¦াধীনতা। তারই ফলশ্রতিতে ২১ফের্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পালিত হচ্ছে গোটা বিশ্বে। তারপরেও আমাদের দেশে মায়ের ভাষাকে মুল্যায়ন করছি না। আমরা বাংলা ভাষাকে পিছনে ফেলে রেখে ইংরেজি ভাষা চর্চা করছি। একবিংশ শতাব্দির জিডিটাল যুগে যেখানে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার সরকারের চেষ্টা চলছে সেখানে আমরা নিজেরাই বাংলার প্রতি শ্রদ্ধা রাখছি না। ভাবতে অবাগ লাগে। ১৯১৮ সালে এক বক্তৃতায় জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন- ‘ আমরা বঙ্গদেশবাসী। আমাদের কথাবার্তার, ভয়-ভালোবাসার, চিন্তা-কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।’ কিন্তু সেই মাতৃভাষাকে আমরা এখনো ভালোবাসতে শিখিনি। আজকের আমরা কী দেখছি- রাস্তা-ঘাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসায় সব েেত্র বাংলার বিপরীতে ইংরেজি ব্যবহার করা হচ্ছে। 

ফ্রেরুয়ারি মাস, ভাষার মাস। রক্তের বিনিময় বাংলা ভাষায় রুপান্তর হয় এদেশ। ভাষার মর্যাদার জন্য রক্তদান কিংবা জীবন বিষর্জন পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল; ফ্রেরুয়ারি মাস আসলেই আমাদের মনে পড়ে যায় ভাষা শহীদদের। এর পরে আর তাদের মনে করি না আমরা। আমরা কতটা স¦ার্থবাদি; যাদের কারণে আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলি, তাদের একটি বারের জন্য মনে করছি না। ফ্রেয়্রয়ারি ভাষা আন্দোলনের সেই আগুনঝড়া মাস। এ মাসেই চূড়ান্তপর্বের দিকে এগিয়ে নিয়েছিল শহীদ, রফিক বরকত আরও অনেকে। ভাষা নিয়ে আমাদের অনেক ইতিহাসই জানা আছে, জানা থাকলেও বাস্তবে চলছে এর ব্যতিক্রম। ভাষা আন্দোলনের ৬১ বছর অতিবাহিত হলো। ৬১বছর আগে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে অস্ত্রের মুখে বুক ঠেলে দিয়েছিলেন বাংলার সাহসী সন্তানরা। একটি বারের জন্যও তারা মনে করেনি এই গুলিতেই তাদের মৃত্যূ হবে। 

১৯৪৭ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র ও অধ্যাপকের উদ্যোগে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এ তমদ্দুন মজলিশ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলাÑ না উর্দু?’ এ নামে একটি পুস্তিকা ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশ করে। এ পুস্তিকাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং তমদ্দুন মজলিশের প্রধান কর্মকর্তা আবুল কাসেম কর্তৃক লিখিত ভাষাবিষয়ক একটি প্রস্তাব সংযোজিত করা হয়। প্রস্তাবটিতে বাংলা ভাষা চালু করার দাবি জানানো হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক নেতৃস্থানীয় ছাত্র ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তারা নতুন ছাত্র সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ল্য, নীতি ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে একটি সার্কুলার প্রচার করেন বাংলায়।

এভাবে বাংলাভাষার জন্য আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এবং তা রক্তয়ী আন্দোলনে রূপলাভ করে। আন্দোলন সফল হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে বাংলা ভাষা। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমী, বাংলা উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শুরু হয় জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম। অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বাংলায় প্রণীত হয় সংবিধান। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের বিধানাবলী পূর্ণরূপে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ‘বাংলাভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ (১৯৮৭ সালের ২ নং আইন) প্রণীত হয়।  

এরপরও কিন্তু বাংলাদেশের অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালুর েেত্র কোন প্রকার বাঁধা থাকার কথা নয়। বাস্তব সত্য যে, বাংলাদেশের অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা পরিপূর্ণভাবে আজও চালু হয়নি। এমনকি উচ্চ আদালতে রায় এবং আদেশ লিপিবদ্ধ হয় ইংরেজীতে। সর্ব েেত্র এখন ইংরেজীকে প্রাধান্য দেয়া হয় বেশি আর বাংলাকে রাখা হয় ইংরেজির পাশাপাশি। অথচ বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাকে রাখার কথা। ১৯৮৭ সালের ২নং আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে এ পর্যন্ত কোন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে শাস্তি দেয়া হয়নি। যদিও উক্ত আইন অহরহ লঙ্ঘিত হচ্ছে। আসলে কাগজে কলমে ভাষা আন্দোলনের স¦াধীন হলেও সত্যিকারের ভাষা আজও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের পিছনের দিকে ফিরে দেখা উচিত- আইন করে কিন্তু বাংলা ভাষা কার্যকর হয়নি; আন্দোলনের মাধ্যমে হয়েছে।  ফের্রুয়ারি মাস আসলেই ভাষার কথা মনে পরে যায়, মনে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার। কিন্তু বাস্তবে সেই শহীদদের মুল্যয়নতো করছি না বরং তাদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্যকেও আমরা ধরে রাখতে পারছি না। 

সকল রাজনীতিবিদ এবং সরকারের প্রতি অনুরোধ- আসুন আমরা সবাই মিলে বাংলা ভাষাকে আরও গতিশীল করি। রাজনীতিবিদরা শুধু মুখেই সব কিছু বলতে পারেন, কিন্তু বাস্তবে তারাই বাংলা ভাষা থেকে বিরত থাকে। ভাষা, সাহিত্য, সং¯কৃতিতে গৌরব ও ঐতিহ্যের অধিকারী বাঙালী জাতি তার মেধা ও মনন দিয়ে আরো বেশি সমৃদ্ধ হবে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন- বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করতে সরকার চেষ্টা করছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি- আগে নিজের ঘর ঠিক না করতে পারলে অন্যের ঘর ঠিক করা সম্ভব নয়। হ্যাঁ আমাদের মায়ের ভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করবেন সেটি অবশ্যই আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়। কিন্তুু আমরা এখনো মায়ের ভাষাকে প্রাধান্য দিতে পারেনি, করতে পারিনি ভাষা শহীদের মুল্যায়ন। আমাদের দেশের প্রত্যেক সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ সকল প্রতিষ্ঠানে আগে মায়ের ভাষাকে বাধ্যতামুলক করা উচিত। 

আমরা মুখে বলি বাংলা ভাষা কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি অন্য। আমরা বাঙ্গালী, আমরা বাংলা সংস্কৃতিকে বিশ্বাস করি। আমরা হারতে শিখিনি। বর্তমানে দেশে বাংলা একাডেমী, বাংলা উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে কিন্তু এতগুলো প্রতিষ্ঠান থাকতেও সত্যিকারের ভাষা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমরা প্রাথমিক শিার দিকে তাকাই; শিার্থীরা বাংলার প্রতি দূর্বল, তারা ইংরেজীতে ফল বেশি পায় বাংলায় পায় তার চেয়ে কম। সত্যিকার অর্থে আমাদেরতো বাংলার বিষয় বেশি ফলাফল আশা করার কথা? দুঃখের সাথে বলতে হয়  যে, ভাষার জন্য আত্মত্যাগের বিনিময় এই দেশে গড়ে উঠতে পারতো একটি আন্তর্জাতিক ভাষা ইনিষ্টিটিউট। বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ নিজ নিজ ভাষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করে কর্মেেত্র কাজ করে থাকেন। অথচ আমাদের দেশে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিতে বাংলা ভাষা আজও দুর্বল। সুতরাং বাংলা ভাষার চর্চা, গবেষণা এবং ভাষার আধুনিকরণ সর্বস্তরে পৌছে দিতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য সরকারকে আরও উদ্যোগি হতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভাষা আন্দোলনের ৬১ বছর অতিবাহিত হলেও বাংলা ভাষার উন্নতি লমাত্রায় পৌঁছেনি। 

স¦াধীনদেশ বাংলাদেশ, বাংলা ভাষার দেশ; কিন্তু আমরা অহরহ দেখে চলেছি সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড, ব্যানার, চাকরীর জন্য জীবন বৃত্তান্ত, চাকরীর জন্য আবেদন, পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন ইত্যাদি সব েেত্র ইংরেজী ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই সকল জায়গায় বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। চাকুরী থেকে শুরু করে সকল পর্যায় জীবন বৃত্তান্ত বাংলায় বাধ্যতামূল করতে হবে। যদিও ইংরেজী ভাষা বিশ্বস¦ীকৃত এবং আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে একি দেখছে মানুষ; বর্তমানে যেভাবে মায়ের ভাষা ছেড়ে দিয়ে ইংরেজি ভাষার দিকে ছুটে চলেছি, তাতে আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মের সন্তানরা কোন দিকে এগোবে সেটি আমাদের ভাবা দরকার! দেশে রাজনীতিবিদ, আমলা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের লোকজন ইংরেজী ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়েছে এমন ভাবে মনে হয় ইংরেজী ভাষা আমাদের মায়ের ভাষা। আমরা একে অন্যের সালামের মধ্যেও ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করে থাকি।  আমাদের মায়ের ভাষাকে প্রযুক্তির সাথে তাল মিলাতে হবে। ইন্টারনেট, ফেসবুকসহ বিভিন্ন নেটওয়ার্কিং প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষাকে অন্তর্ভূক্ত করা উচিত পদ্যতিগতভাবে।  কিন্তু কেন? এ জন্যই কী রক্তের বিনিময় রাষ্ট্রভাষা বাংলায় রূপান্তর করেছে আমাদের বীর শহীদরা। সুতরাং এটি সহজেই অনুমেয় যে, এখনো রাষ্ট্র ভাষা বাংলা সঠিকভাবে রুপান্তরিত হয়নি। ভাষা আন্দোলন বলতে সাধারণতঃ ৫২ এর ভাষা আন্দোলনকেই বুঝায়, কিন্তু প্রকৃত পে মাতৃভাষা নিয়ে ুদ্র ুদ্র আন্দোলন বা সংগ্রাম দেশে বিভাগের অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। তেমনি শুধু ৫২এর আন্দোলনই শেষ নয় এখনো বাংলা ভাষার আন্দোলন শেষ হয়নি। আসুন আমরা সবাই বাংলা ভাষাকে মায়ের মত করে বুকে টেনে নেই। তা নাহলে ভাষা শহীদদের আত্মা হয়তো শান্তি পাবে না। আসুন নিজের মাকে যেমন বুকের ভিতরে আগলে রেখে সম্মান  মর্যাদা দেই, তেমনি বাংলা ভাষা ব্যবহারের েেত্রও কারপন্যতা না করে নিজের মায়ের মতো বুকের ভতরে লালন করে বাংলা ভাষাকে সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করি। 

লেখক- শফিকুল ইসলাম খোকন, সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক
প্রকাশিতঃ দৈনিক যায়যায়দিন, তারিখঃ ৮ফের্রুয়ারি ২০১৬

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নদী মরলে দেশও মরবে

: শফিকুল ইসলাম খোকন : নদীমাতৃক দেশে নদীই আমাদের ভরসা। নদী আমাদের হৃৎপিণ্ড, নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না, প্রকৃতি বাঁচবে না, পরিবেশের সুরক্ষা ...