শফিকুল ইসলাম খোকন

শনিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৮

মানব পাচার রোধে ভূমিকা রাখতে পারে স্থানীয় সরকার

: শফিকুল ইসলাম খোকন :

মানব পাচারকারী চক্র কি এতই শক্তিশালী যে তাদের কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না? অথচ মানব পাচারকারীরা কোনো না কোনে স্থানীয় ইউনিটে বসবাস করছে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা তাদের ভালোভাবেই চেনেন। কিন্তু স্থানীয় সরকারগুলো কার্যকর না থাকায় প্রতিনিধিরা এ দুষ্কৃতকারীদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসছেন না।

মানব পাচার শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর েেত্র এ ধরনের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। বর্তমানে এ সমস্যার অন্যতম শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন। জমিজমা, ভিটেমাটি বিক্রি করে কর্মসংস্থানের আশায় মানব পাচারকারী বা দালালদের হাতে টাকা দিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন। বেকারত্ব থেকে মুক্তি পেতে, একটু ভালো জীবন খুঁজে পেতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দরিদ্র দেশের লাখ লাখ যুবক প্রতিবছর ছুটে যাচ্ছে অপোকৃত উন্নত রাষ্ট্রে। পাচারকারীদের অল্প অর্থে বিদেশ পাঠানোর প্রলোভনে ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও অবৈধ উপায়ে সমুদ্রপথে বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছে এসব মানুষ।

একটি গণতান্ত্রিক দেশের জনগণের সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠান হল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। এর প্রধান কাজ জনগণের প্রত্য অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্দিষ্ট এলাকার আর্থসামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন ছাড়াও এলাকার শান্তিশৃংখলা সমুন্নত রাখা। সেজন্য গণতন্ত্র ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পরস্পরের পরিúূরক। প্রাচীনকাল থেকেই দেশে নির্দলীয় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা একটি ঐতিহ্য বহন করে আসছে। প্রাচীন ভারতে একসময় গ্রামীণ শাসন ব্যবস্থার মূলভিত্তি ছিল পাঁচজন নির্বাচিত বা মনোনীত ব্যক্তি নিয়ে গঠিত গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠান; পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। স্থানীয় সরকার যতণ পর্যন্ত জনগণের সবচেয়ে কাছের সরকার না হবে ততণ একে স্বশাসিত বলা যাবে না এবং তাকে কেন্দ্রীয় সরকারের লেজুড়ভিত্তিক সরকার হিসেবে থাকতে হবে।

স্থানীয় অধিবাসীরা ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন কিংবা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের যে কোনো একটিতে বসবাস করে। স্বভাবতই মানব পাচার রোধে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকার কর্তৃপরে ভূমিকা বা তদারকি থাকলে শুধু মানব পাচারের মতো ঘটনাই নয়, এ ধরনের বহু দুষ্কর্ম প্রতিরোধ করা সম্ভব। স্থানীয় কর্তৃপ তথা স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন) ছাড়া দেশ যেমন গণতান্ত্রিক পন্থায় পরিপূর্ণভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়, তেমনি স্থানীয় সরকার ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার চাকাবিহীন গাড়ির মতো।

দুবছর আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক স্থানীয় সরকার সম্মেলন-২০১৩ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তার সরকারের ল্য হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারকে নীতি প্রণয়ন, তদারকি ও বাজেট প্রণয়নে সম্পৃক্ত রাখা। অপরদিকে সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার। আমরা বারবার বলে আসছি, এ দেশের ভৌগোলিক আয়তন, জনসংখ্যা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ইত্যাদি বিবেচনায় দুধরনের সরকার ব্যবস্থা তথা কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাই বাস্তবায়নযোগ্য। এ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য পররাষ্ট্র, প্রতিরা, মুদ্রাসহ জাতীয় কাজগুলো নির্দিষ্ট থাকবে এবং অন্যসব কাজ স্থানীয় সরকার বাস্তবায়ন করবে। সেই সঙ্গে অব্যাহত নগরায়ণের প্রোপটে নগরীয় কাজ, গ্রামীণ কাজ ও গ্রামীণ-নগরীয় কাজ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য স্থানীয় সরকারগুলোর স্তর বিন্যাস করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় আরও বলেছিলেন, স্বাধীনতার পর গণতন্ত্রের ধারা বারবার বাধাগ্রস্ত হওয়ায় স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তার বক্তব্যের সমর্থনে বলা যায়, জনগণের মতায়নের ল্েয কর্মসূচি গৃহীত না হওয়ায় গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পার্শ^বর্তী দেশ ভারতে সাংবিধানিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার ও স্থানীয় সরকারের কাজ ও ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। আর আমাদের দেশে ঔপনিবেশিক আমলের মতো সব মতা প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় মতার গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রায়র আজও সম্ভব হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে কেউ কেউ বলে থাকেন সেখানে ুদ্রঋণের মতো সরকার ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে। ফলে সরকারের প্রাণভোমরাও এক জায়গায় থাকে না। বর্তমান সরকার মতায় আসার পর একাধিক মন্ত্রী/এমপির মুখে শোনা গেছে, তারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের পর স্থানীয় সরকার কার্যকর করবেন।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, গণতান্ত্রিক দেশে কি গণতন্ত্র বিনির্মাণের কাজ বন্ধ রেখে অপরাধের বিচার করা হয়? স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রায়ন হওয়া মানে জাতীয় পর্যায়েও গণতন্ত্র প্রাণশক্তি পাওয়া। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতীয় সীমান্তরী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশী বাসিন্দাদের পুশব্যাক করে; কিন্তু বাংলাদেশী সীমান্ত থেকে ভারতের কোনো নাগরিককে ভারতে পাঠানোর কোনো ঘটনা কি দেখা যায়? অথচ স্থানীয় সরকার কার্যকর থাকলে স্থানীয় প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় আইনশৃংখলা বাহিনী এ কাজটি করতে পারত। তেমনি বর্তমানে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে মানব পাচার রোধেও স্থানীয় কর্তৃপ তথা স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অপরিসীম। স্থানীয় কর্তৃপ বা স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধিরা স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনবৃত্তান্তসহ সবকিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন। কোনো এলাকার নাগরিকদের বিদেশে যেতে হলে স্থানীয় পরিষদ থেকে পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন ইত্যাদি সংগ্রহ করতে হয়। সে েেত্র স্থানীয় কর্তৃপ খুব সহজেই বুঝতে পারে
কে বিদেশে যাচ্ছে কিংবা ওই ব্যক্তি কোনো প্রতারক চক্রের বেড়াজালে পড়ে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে কি-না। সেজন্য অবিলম্বে দুধরনের সরকার ব্যবস্থার অধীনে সমুদয় স্থানীয় কাজ স্থানীয় সরকারগুলোর হাতে ন্যস্ত করতে হবে এবং প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে সরকার কাঠামো (যেমন ইউনিয়ন সরকার, নগর সরকার, জেলা সরকার ইত্যাদি) প্রতিস্থাপন করতে হবে। সংেেপ ইউনিয়ন সরকারের রূপরেখা তুলে ধরা যেতে পারে।

ইউনিয়ন প্রশাসন, ইউনিয়ন সংসদ ও ইউনিয়ন আদালত মিলে ইউনিয়ন সরকার গঠিত হবে। ইউনিয়ন আদালত ইউনিয়নকেন্দ্রিক অপরাধের বিচার করবে। ইউনিয়ন সংসদ ইউনিয়নকেন্দ্রিক বিধি-বিধান তৈরি ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রস্তাবগুলো পাস করবে। ইউনিয়ন প্রশাসন চেয়ারম্যানের অধীনে থেকে পরিচালিত হবে। ইউনিয়ন প্রশাসন ইউনিয়ন সংসদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। ইউনিয়ন প্রশাসনের অধীনে ইউনিয়ন পুলিশ কর্মরত থাকবে। তারা অপরাধীদের ধরে ইউনিয়ন আদালতে সোপর্দ করবে। এ ব্যবস্থা গৃহীত হলে জনগণই সরকার, জনগণই পুলিশ এবং জনগণই মূল শক্তি- এ ধরনের নীতিগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হবে। একটি সুপরিকল্পিত ও টেকসই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হলে মানব পাচারের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর ঘটবে না। দেখতে হবে না মানুষের ক্রন্দন।

শফিকুল ইসলাম খোকন : স্থানীয় সরকার গবেষক এবং সদস্য, সিডিএলজি

২১ মে ২০১৫ সালে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নদী মরলে দেশও মরবে

: শফিকুল ইসলাম খোকন : নদীমাতৃক দেশে নদীই আমাদের ভরসা। নদী আমাদের হৃৎপিণ্ড, নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না, প্রকৃতি বাঁচবে না, পরিবেশের সুরক্ষা ...